১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটারের দেশ যখন জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন পুরো একটি গ্রাম শত শত বছর ধরে পড়ে আছে জনশূন্য। বাংলাদেশে এমন একটি গ্রাম রয়েছে যেই গ্রামে কোনো মানুষ বসবাস করেনা। আছে ফসলি জমি, পুকুর ও সবুজ বৃক্ষ। নেই শুধু মানুষের কোলাহল।
গ্রামটির নাম মঙ্গলপুর। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে রয়েছে এই গ্রামটি। কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। সরকারি নথিতে গ্রামটির সুস্পষ্ট অস্তিত্বও রয়েছে।
জনশ্রুতি আছে, বহুবছর পূর্বে এই গ্রামের মানুষের মধ্যে ‘অমঙ্গল’ আতঙ্ক ভর করেছিলো। তখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় মানুষ। সেই থেকে গ্রামটি মানুষশূন্য। এখনো গ্রামজুড়ে রয়েছে ধান, মসুরি, আঁখসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত এবং ফলের বাগান। রয়েছে বেশ কয়েকটি বসতভিটার ধ্বংসাবশেষ, বেশ কিছু পুকুরও। যা প্রমাণ করে এককালে এখানে মানুষের বাস ছিল খুব ভালো ভাবেই। তবে কেন এখানে কেউ বাস করে না? এমন প্রশ্ন আপনার মনেও নিশ্চয় জেগে উঠছে বারবার। চলুন জেনে নেয়া যাক এর নেপথ্যের কাহিনী।
এ ব্যাপারে কোটচাঁদপুর এলাকার প্রবীন ব্যক্তিরা জানান, ১০০ বছর পূর্বে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যান। আতঙ্কে অন্যরা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। কিছু পরিবার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যান। মঙ্গলপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল। গ্রামে যখন কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে তখন অনেক মানুষ মারা যান। ওই সময় গ্রামে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের খাল-বিল, পুকুর-কুয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। এই প্রচারের পর গ্রামের মানুষ দল বেঁধে ভারতে চলে যায়। কিছু মানুষ পাশের গ্রামগুলোতে চলে গিয়েছিল, যারা পরে অন্যত্র চলে গেছেন।
এসব অনেক অনেক বছর আগেকার কথা। তবে তারও অনেক পরে, আজ থেকে ৮০-৯০ বছর আগেও হাজরা ঠাকুর, নিপিন ঠাকুররা কয়েকঘর এখানে ছিলেন। তারা মারা যাওয়ার পর সর্বশেষ তাদের পরিবারের নেটো ঠাকুর নামের একজন মঙ্গলপুরে থাকতেন, তিনি পরবর্তীতে খুন হলে গ্রামটি সম্পূর্ণভাবে মানুষশূন্য হয়ে পড়ে।
জানা যায়, এই অঞ্চলে মঙ্গল পাঠান নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার নামেই পরবর্তীতে গ্রামটির নামকরণ করা হয় মঙ্গলপুর। মঙ্গল পাঠানের তিন একর জমির উপর ছিল বিশাল এক বাড়ি। বাড়ির চারদিকে উঁচু করে ৩০ থেকে ৪০ ইঞ্চি চওড়া মাটির প্রাচীর ছিল। পাশের পুকুরের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়েও বাড়ির ভেতরের কাউকে দেখা যেত না। তার পরিবার ছিল খুবই পর্দাশীল। বাড়ির মেয়েরা কখনো বাইরে বের হতো না। এমনকি বাইরের কোনো পুরুষের সঙ্গে দেখাও দিতেন না। মঙ্গল পাঠান একসময় সেখানেই মারা যান। তার কবর এখনো রয়েছে এই গ্রামে।
এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ গ্রাম কী কারণে এমন মানবশূন্য হয়ে গেল তা ঠিক কেউই বলতে পারে না। আর সময়টাও অনেক বয়ে গেছে। তাই এই প্রজন্মের কেউ এই ব্যাপারে খোঁজও রাখেন না। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হচ্ছে- এক সময় এখানে কলেরা এবং গুটি বসন্ত দেখা দিলে গ্রামের মানুষ মারা যেতে থাকে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু। ডাক্তার- কবিরাজ, ওঝা, ওষুধ-ঝাড়ফুঁক কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে কোনো দৈব শক্তির কারণে এমনটা হচ্ছে। এখানে থাকলে তারা কেউই বাঁচবে না। তাই সবাই সব রেখেই গ্রাম ছেড়ে পালাতে থাকে। পরবর্তীতে তাদের উত্তরসূরিরা এসে তাদের জমি পাশের গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করে দিয়ে যেন ঝামেলা মুক্ত হয়। তারাই এখন এই সব জমিতে চাষাবাদ করছেন। তবে বসতি গড়েননি কেউ।
এলাঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদের সূত্রে জানাযায়, এলাঙ্গী ইউনিয়নটি ১৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। যার মধ্যে মঙ্গলপুর একটি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও যশোরের চৌগাছা উপজেলার সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম এই মঙ্গলপুর।
এলাঙ্গী ভূমি অফিসের সূত্রানুসারে, মঙ্গলপুর গ্রামটি ৬৬ নম্বর মঙ্গলপুর মৌজায় অবস্থিত। এই মৌজায় একটিই গ্রাম রয়েছে। গ্রামে ২০৬ টি খতিয়ানভুক্ত জমি আছে। কিন্তু কোনো পরিবার নেই।
আপনার মতামত লিখুন :