বাজার থেকে ব্রি-২২ ধানের বীজ কিনে চারা তৈরি করে ১২০ শতক জমিতে রোপণ করেছিলেন কৃষক কামরুল ইসলাম। গাছ বড় হলেও তাতে ধান হয়নি। আগুনে পোড়ার মতো হয়ে ছিটা হয়েছে।
মাঠে অন্য কৃষকদের জমিতে রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও কামরুল ইসলামের জমিতে ধান হয়নি।
কৃষি কর্মকর্তা, অন্যান্য কৃষক ও দোকানির সাথে কথা বলে জানতে পারেন ওই বীজ ধান ভেজাল ছিল। ব্রি-২২ বলে দোকানি তাঁকে দিয়েছিল সাধারণ ধান।
এতে ফসল ঘরে তোলা হয়নি কামরুলের। উল্টো জমি চাষাবাদের খরচ গচ্ছা গিয়েছে।
অনুরোধ করার পরও বীজ দোকানি ক্ষতির চিত্র দেখতে যাননি বলে জানান কামরুল।
পরে প্রতিকার পেতে ভুক্তভোগী কৃষক কামরুল ইসলাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী কৃষক কামরুল ইসলাম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার পেরিরচর গ্রামের বাসিন্দা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামরুল ইসলামের মতো আরও অগণিত কৃষক ভেজাল বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন। এতে উপজেলা জুড়ে ৫০ একরের বেশি জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
কৃষক কামরুল ইসলাম জানান, কয়েক মাস আগে মোহনগঞ্জ শহরের তুলাপট্টি রোডের আরাবী বীজ ঘর থেকে ব্রি-২২ ধানের বীজ কিনে চারা তৈরি করে ১২ কাটা (১২০ শতক) জমিতে রোপণ করি। গাছ কিছুটা বেড়ে ধান বের হয়নি। ধান গাছের উপরের অংশটা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মাঠে অন্য সবার ফসল ভালো হলেও আমার খেতে ধান হয়নি। পরে জানতে পারলাম ব্রি-২২ ধানের বীজ বলে ভেজাল বীজ দিয়েছে দোকানি। এতে জমওর ফসল ও চাষাবাদের খরচ সব লোকশান হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার মতো আরও অনেকে ভেজাল বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন। বিষয়টি কৃষি কর্মকর্তাকে অবহিত করা হয়েছে। দোকানিকে অনেক বার অনুরোধ করেছি ক্ষতিগ্রস্ত খেতটা দেখে যেতে৷ কিন্তু তিনি পাত্তাই দেননি। প্রশাসন এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে আশা করছি। যেন ভবিষ্যতে আর কোন কৃষক এভাবে প্রতারিত না হয়।
ভুক্তভোগী আরেক কৃষক নাকডরা গ্রামের খোকন মিয়া বলেন, এবার ২ একর জমিতে আমন ধান রোপন করেছিলাম। ভেজাল বীজের কারণে কোন ধান হয়নি। চাষাবাদ, সার-বিষ সব লোকশান হয়েছে। ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা চান তিনি।
পেরিরচর গ্রামের কৃষক আজিজুল হক বলেন, ২ একর ২০ শতক জমিতে আমন ধান রোপন করেছিলাম। কোন ধান হয়নি। ভেজাল বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছি। অভিযোগ দিয়েও ফল পাচ্ছি না।
গৌরাকান্দা গ্রামের কৃষক হেলিম মিয়া ২ একর জমিতে ধান রোপন করেছিলেন ভেজাল বীজের কারণে তার জমিতেও কোন ধান হয়নি।
নাকডরা গ্রামের কৃষক শাহীন মিয়া বলেন, ভেজাল বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছি। ১২০ শতক জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ভেজাল বীজ বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
কুচিরগাঁও গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়ার বলেন, আমার ২৫ শতক জমির ধান নষ্ট হয়েছে ভেজাল বীজের কারণে।
গৌরাকান্দা গ্রামের কৃষক সাজাউল করিম মোতাহার বলেন, বাজে বীজের কারণে আমার ৫০ শতক জমির ধান ধ্বংস হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ` আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি উপজেলা জুড়ে এমনিভাবে অগণিত কৃষক ভেজাল বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন। শত একরের বেশি জমির ফসল নষ্ট হয়েছে ভেজাল বীজের কারণে। অনেকেই অভিযোগ করেন না। ফলে সঠিক হিসেবটা পাওয়া যায় না। ভেজাল যেসব দোকানে বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০-৪০টি দোকানে ধান বীজসহ নানা বীজ বিক্রি হয়। ফসলের সময়ে তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত করে অধিক লাভের জন্য কৃষকদের কাছে ভেজাল বীজ বিক্রি করে। এতে অসংখ্য কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে কৃষকরা এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে তেমন অভিযোগ করেন না।
এ বিষয়ে মোহনগঞ্জ শহরের তুলাপট্রিতে থাকা আরাবী বীজ ঘরের মালিক রুবেল মিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিজনের শেষ সময়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের কিছু ব্যবসায়ী খোলা ধান বীজ নিয়ে এসে আমাদের কাছে বিক্রি করে। চহিদা থাকায় আমরা বাজারের সব দোকানি ওইসব বীজ কিনে রাখি। পরে দেখা যায় এসব ভেজাল বীজ নিয়ে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরে জানাতে গেলে মধুপুরের ওই ব্যবসায়ীকে আর ফোনে পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুশ শাকুর সাদী বলেন, ভেজাল বীজের কারণে কৃষকের ক্ষতির বিষয়টি অবগত হয়েছি। সাধারণ ধান প্যাকেট করে বীজ ধান হিসেবে কৃষকের কাছে বিক্রি করে। ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। ইতিমধ্যে একজন কৃষক এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষয়টি অবহিত করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জুয়েল আহমেদ বলেন, খোঁজ নিয়ে দ্রুত ভেজাল সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :