নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিধি পরিপন্থীভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ার দখলের অভিযোগ উঠেছে এক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে এখনও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ওই চেয়ারটি ধরে রাখায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে একই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। অভিযোগ ওঠা অধ্যক্ষের নাম মমতাজ জাহান। তিনি নওগাঁর বদলগাছী মহিলা কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।
এদিকে, অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাকে অপসারণ করে ওই পদের জন্য যোগ্য কাউকে নিয়োগ দিতে চিঠিও দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু সব কিছুকে উপেক্ষা করে এখনও বহাল তবিয়তে দায়িত্বে আছেন অধ্যক্ষ মমতাজ জাহান। এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ কলেজটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই বদলগাছী মহিলা কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মাহবুব আলম নামে এক শিক্ষক। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গত বছর ২৭ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একই কলেজের এক ছাত্রীসহ কিছু শিক্ষার্থী অধ্যক্ষ মাহবুব আলমের বিরুদ্ধে অনিয়ম এবং দূর্নীতির অভিযোগ তুলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুব হাসানের কাছে স্মারক লিপি জমা দেন। সেই সাথে তার বহিষ্কার দাবী করা হয়।
এর প্রেক্ষিতে ২৭ অক্টোবর ইউএনও সিচুয়েশন মোকাবেলা করতে অধ্যক্ষ মাহবুব আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। পরে ইউএনও এবং এডহক কমিটির সভাপতি লুৎফর রহমান ওই কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মমতাজ জাহানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব দেন। কিন্তু ওই কলেজে স্মাতক পর্যায়ে সমাজকর্ম বিষয়ের অধিভুক্তি নেই। যার কারণেই চাকুরী বিধি অনুযায়ী মমতাজ জাহান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন একেবারেই অবৈধ।
বিষয়টি নিয়ে কলেজের শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অবশ্য তিনি সমাজকর্ম বিভাগের হওয়ায় বিধি পরিপন্থী মন্তব্য করে গত ২২ ডিসেম্বর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডহক কমিটিকে চিঠি দিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিধি মোতাবেক স্নাতক পর্যায়ে স্বীকৃত কোন বিষয়ের জ্যেষ্ঠতম এক জন শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করে অধ্যক্ষ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য বলা হয়। কিন্তু এই চিঠি প্রাপ্তির প্রায় এক মাস পার হলেও কলেজের এডহক কমিটি কোন ব্যবস্থা নেননি।
ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। ভবিষ্যতে তাদের বেঁধে দেওয়া নিয়ম ও নির্দেশনা থেকে উঠে যাবে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মন এমনটিই মনে করছেন তারা।
অপরদিকে মমতাজ জাহানের অপসারণের দাবিতে আবারও ফুঁসে উঠেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমাদের ভুল বুঝিয়ে ম্যাডামের পক্ষে কথা বলতে বলা হয়েছে। তাই আমরা আন্দোলন করেছি এবং মমতাজ জাহানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসতে বাধ্য করিয়েছি। এখন আমাদের ভুল বুজতে পারছি। তাই নিয়ম অনুযায়ী বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষ নিয়োগের জোর দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আবার আন্দোলন করতে বাধ্য হবো বলেও তারা হুমকি দেন।
এছাড়া দ্রুত সুষ্ঠু সমাধান চাইলেন কলেজে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষকরা। আর অধ্যক্ষ বলছেন তিনি বৈধভাবে দায়িত্ব পেয়েছেন। আবার এডহক কমিটি বলছেন আগের অধ্যক্ষ দায়িত্ব পেলে, মমহাজ কেন পারবেন না।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় কলেজটির বাংলা বিভাগের প্রভাষক মেহেদী হাসানের সাথে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মমতাজ জাহানের পক্ষে একাধিক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়েছেন। তাছাড়া এই শিক্ষার্থীরা কিভাবে বুজলো, আগের অধ্যক্ষ মুকুলের অনিয়ম আছে। তাদের শেখানো বুলিতেই ছাত্ররা আন্দোলন করেছে। এবং মমতাজকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিতে বাধ্য করেছে। এখন সেই সকল শিক্ষার্থী আবার মমতাজের অপসারণ চাচ্ছে। আমরা চাই নিয়ম মেনে কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হোক।
ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক আজাদ হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, মমতাজ জাহান জেষ্ঠ্যতার বিধি লঙ্ঘন করে দায়িত্ব নিয়েছেন। ততকালীন ইউএনও অনেকটাই বাধ্য হয়েই তাকে দায়িত্ব দিয়ে যান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অনিয়ম চলতে পারে না। দ্রুতই এর সমাধান প্রয়োজন।
একইভাবে দ্রুত সমাধান চাইলেন সহকারী অধ্যাপক সারমিনা, সহকারী অধ্যাপক উম্মে হাবিবা এবং আরেক সিনিয়র প্রভাষক হাসিব চৌধুরী। তারা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি চিঠি দিয়েছে তা জেনেছেন। মমতাজ জাহানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই চুপচাপ করে হয়েছে। ৫ আগষ্টের পর কিছু শিক্ষার্থীকে ভুল বুঝিয়ে ইউএনও অফিসে নিয়ে যান। সেখানে ইউএনও কে চাপ প্রয়োগ করে দায়িত্ব নেন মমতাজ জাহান। এ বিষয়ে আগে থেকে কেউ কিছুই জানতেন না। শুনেছিলাম আনোয়ার স্যারকে ডাকা হয়েছিল এবং জানতাম আনোয়ার স্যার দায়িত্ব পাচ্ছেন। কিন্তু পরে দেখা যায় উল্টো চিত্র। এছাড়া এই কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার একাধিক যোগ্য শিক্ষক আছেন বলেও জানান তারা।
এদিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহানের পক্ষে সাফাই গেয়ে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র প্রভাষক আবু হেনা হাসনাত বলেন, আগের অধ্যক্ষ অনেক অনিয়ম করে গেছেন। তাই নিয়ম অনুযায়ী মমতাজ জাহানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সমাজকর্ম বিভাগ চালুর জন্য আবেদন করা হবে। যেকোন সময় অনুমোদন পেয়ে যাব। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকল কাজ করে আনা সম্ভব বলে গল্পের ছলে মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ওঠা শিক্ষার্থীদের ম্যানেজ করার বিষয়টি মিথ্যে বলে দাবি করেন তিনি।
একইভাবে চিঠি পাওয়ার পর আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে বদলগাছী মহিলা ডিগ্রী কলেজের বর্তমান দায়িত্ব পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মমতাজ জাহান বলেন, ৫ আগষ্টের পর সারাদেশে ছাত্র সমন্বয়কদের যে চাওয়া ছিল, তারই প্রেক্ষিতে কলেজের ছাত্রদের পছন্দের তালিকায় হয়তোবা আমি ছিলাম। আর তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে আমার পক্ষে কথা বলার প্রয়োজন পড়েনা। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চিঠি সম্পর্কে তিনি বলেন, যেহেতু সমাজকর্ম বিষয়ে চেয়েছে, তাই আমিও সমাজকর্ম বিষয় পাঠদান চালুর জন্য আবেদন করেছি। তবে মাউশির নীতিমালা অনুযায়ী আমার নিয়োগ বৈধ।
শনিবার (১৮ জানুয়ারি) জানতে চাওয়া হয় কলেজের এডহক কমিটির সভাপতি লুৎফর রহমানের কাছে। তিনিও সাফাই গেয়ে মুঠোফোনে বলেন, আমরা বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদেরকে আবেদন দিতে বলেছে। এছাড়া আগের অধ্যক্ষেরও সাবজেক্ট অনুমোদন ছিলনা। তারপরও তাকে বেতন সুবিধা দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আর মমতাজ জাহান তো বেতন নিচ্ছেনা। এই বিষয়গুলো আমরা বলেছি। তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম ঠিক নেই এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি সেটা বলতে যাব কেন? তারা আবেদন দিতে বলেছে, আমরা আবেদন দিয়ে এসেছি।
আপনার মতামত লিখুন :