আগামী দিনগুলোতে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের (এলডিসি) ফলে ২০৩১ সাল নাগাদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোশাক রপ্তানি কমতে পারে ১৪ শতাংশ। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে কাজ হারাবে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১০ লাখ মানুষ। আর প্রযুক্তি দক্ষতার অভাবে এরই মধ্যে পোশাক খাতে কমেছে নারীর অংশগ্রহণ।
গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্রথম অধিবেশনে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রযুক্তি, সাপ্লাই চেইন এবং কর্মসংস্থান শীর্ষক অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের টেকসই আরএমজি বৃদ্ধি জন্য সাপ্লাই চেইন গতিশীলতা’, ‘টেকনোলজি আপগ্রেডেশন অব দ্য আরএমজি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ’, ‘শিল্প খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন’ এবং ‘উৎপাদন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বিআইডিসের গবেষকরা। ‘বাংলাদেশের টেকসই আরএমজি বৃদ্ধি জন্য সাপ্লাই চেইন গতিশীলতা’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন। সেখানে আগামী দিনে তৈরি পোশাক শিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়। আরও বলা হয়, দেশের জন্য এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ডিউটি-ফ্রি ও কোটাহীন সুবিধা হারানো।
প্রতিবেদনে মনজুর হোসেন জানান, ২০২৬ সালের পর বড় উন্নত দেশের বাজারগুলোতে ডিউটি-ফ্রি সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাজারে। যেখানে পোশাক, কাপড় এবং আধা প্রস্তুত পণ্যের ওপর ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত হতে পারে। এই সুবিধাগুলোর অবসান এবং এলডিসির জন্য বরাদ্দ বিশেষ নিয়মাবলি হারানোর কারণে ২০৩১ সাল নাগাদ আরএমজি খাতের রপ্তানি আয় প্রায় ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কমতে পারে।
এতে বলা হয়, উন্নত দেশগুলো শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশের জিডিপিতে শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে যেতে পারে। আরএমজি খাতের রপ্তানি প্রায় ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয় যা বর্তমানে ৮৪ শতাংশ। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে আরএমজি কোম্পানিগুলোকে খরচ কমানোর পাশাপাশি বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় উৎপাদন-পরবর্তী পর্যায়েও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়। শিপমেন্টের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাস্তার অবকাঠামো সমস্যা, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে অদক্ষতা, এবং বন্দরের কার্যক্রমে দেরি বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশেষত চট্টগ্রাম বন্দর এশিয়ার সবচেয়ে অকার্যকর কনটেইনার হ্যান্ডলিং বন্দর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের আরএমজি খাতের টেকসই এবং প্রতিযোগিতামূলক বৃদ্ধির জন্য একটি শক্তিশালী এবং টেকসই সরবরাহ চেইন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করেন মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, এ চেইন অদক্ষতার সমাধান করতে দ্রুত নীতি পরিবর্তন প্রয়োজন। আরএমজি খাতের সব অংশীজন সরকার, উৎপাদনকারী এবং অন্যান্য সংস্থাকে একত্রে কাজ করতে হবে, যাতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী উন্নত বাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায়। সরকারের উচিত অবকাঠামো উন্নয়ন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, এবং সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
তৈরি পোশাক খাতে কমেছে নারীর অংশগ্রহণ: টেকনোলজি আপগ্রেডেশন অব দ্য আরএমজি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক উপস্থাপনায় বিআইডিএসের গবেষক কাজী ইকবাল বলেন, গত ১০ বছরে তৈরি পোশাক খাতের বেশিরভাগ উপখাতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। অর্থাৎ আটটি উপখাতের মধ্যে ছয়টিতে কমেছে, বেড়েছে মাত্র দুটিতে। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালে দেশের পোশাক খাতের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সালে তা ৫৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
কাজী ইকবাল বলেন, তৈরি পোশাক খাত গত ১০ বছরে অনেক বেশি পুঁজিঘন হয়েছে। সঙ্গে শ্রমিকপ্রতি যন্ত্রের সংখ্যা কমেছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মেশিন অপারেটর ও হেলপারদের ওপর। সামগ্রিকভাবে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। প্রতিবেদনের ওপর এক প্রশ্নের জবাবে গবেষক জানান, নারীরা কোথায় কোথায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে সমস্যার মুখে পড়ছেন, তা চিহ্নিত করে তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো দরকার। তাহলে তাদের ঝরে পড়ার হার রোধ করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসের গবেষক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, দেশে এ মুহূর্তে প্রযুক্তির কারণে বড় ধরনের ছাঁটাই হচ্ছে, তা নয়। এ প্রক্রিয়া সবখানেই থাকবে। দরকার হচ্ছে, নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা বা তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো, এবং প্রয়োজনবোধে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া।
উৎপাদন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পোশাক খাতে কাজ হারাবে ১০ লাখ: বিআইডিএসর সম্মেলনে উৎপাদন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাব শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম। উৎপাদন খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে কর্মসংস্থানে কী প্রভাব পড়বে, তার তুলনামূলক চিত্র দেখান তিনি।
প্রতিবেদনে ফারহিন ইসলাম বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ১৮ লাখ কর্মীর কাজ চলে যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে। এই খাতে ১০ লাখ মানুষের কাজ চলে যেতে পারে। তবে কর্মসংস্থান কমার এই হিসাব করা হয়েছে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে। এই খাতের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নতুন যত কর্মসংস্থান হবে, তা ছাঁটাইয়ের চেয়ে বেশি।
তিনি জানান, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে উৎপাদন খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থান হবে। যেসব খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার হবে মানব শ্রমের সহায়ক শক্তি হিসেবে, সেসব খাতে ছাঁটাই হবে কম। আর যেখানে মানব শ্রমের বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে, সেখানে ছাঁটাই হবে বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :