শুধু শিক্ষার আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রেই নয় বরং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও সুপরিচিত দেশের উচ্চশিক্ষায় দ্বিতীয় প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। প্রতি বছর শীতকালের শুরুতেই ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসটির বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা যায় নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখির অবাধ বিচরণ। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। সাধারণত বর্ষার শেষে এবং শীতের শুরুতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই এসব পরিযায়ী পাখির দেখা মিলতো রাবি ক্যাম্পাসে। তবে নভেম্বর পেরিয়ে ডিসেম্বর চলে গেলেও ক্যাম্পাসে এবছর ক্যাম্পাসে এসব পাখির আনাগোনা তেমন নেই।
ক্যাম্পাসসূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের খালেদা জিয়া, তাপসী রাবেয়া, রহমতুন্নেছা হলের পেছনের চামপঁচা পুকুর, রহমতুন্নেসা হলের পাশের পুকুর, তুঁতবাগানসংলগ্ন পুকুর, কৃষি অনুষদ ভবনসংলগ্ন পুকুরসহ বেশ কয়েকটি জলাশয়ে দেখা যেত পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এসব পরিযায়ী পাখির বিচরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের পুকুরগুলো লিজ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে, যেখানে মাছ চাষিরা পাখিদের আগমন রোধে দড়ি টানানোর মতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন, যা পাখিদের জলাশয়ে নামতে বাধা দিচ্ছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি পুকুর ভরাট করে ২০ তলাবিশিষ্ট একাডেমিক ভবন, দুটি আবাসিক হল ও একটি শিক্ষক কোয়ার্টারের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল নির্মাণের জন্য খালেদা জিয়া, তাপসী রাবেয়া, রহমতুন্নেছা হলের পেছনের চামপঁচা পুকুর ভরাট করা হয়েছে, যেই পুকুরেই প্রতিবছর পরিযায়ী পাখিরা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমাতো। এদিকে পরিযায়ী পাখি না আসার জন্য ক্যাম্পাসে বিভিন্ন উৎসব, নির্মাণকাজের উচ্চ শব্দ, মানুষের অবাধ যাতায়াত, যানবাহনের শব্দ এবং আলো দূষণকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাখি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের মৌসুমে উত্তরের সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন এবং হিমালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকার দেশগুলো থেকে উষ্ণ জলবায়ু এবং খাদ্যের সন্ধানে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসে। এদের মধ্যে বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বড় সরালি হাস, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, ভূতি হাঁস ও ঝুঁটি হাঁস,বালিহাঁস, ইত্যাদি।
পরিযায়ী পাখি নিয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজার সাথে। তিনি জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের নানা কার্যকলাপ, যা তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যাহত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে। জলাশয় ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। পুকুর বা জলাশয়গুলো মাছ চাষের জন্য লিজ দেওয়া হচ্ছে, যা পাখিদের প্রাকৃতিক আবাসস্থলকে ব্যাহত করছে। জলাশয়ে মাছ চাষের কারণে পাখিদের খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, মানুষের কার্যক্রম পাখিদের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্মাণকাজ একটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে পরিযায়ী পাখিদের উপরে। পুকুর লিজ দিয়ে যে মাছ চাষ হয় তখন পানিতে ন্যাচারাল ওয়াটার বডি থাকে না। আবার পাখিরা যেন বসতে না পারে সেজন্য দড়ি দিয়ে রাখে যা পাখিদের জলাশয়ে নামতে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জলাভূমি গুলো কমে যাওয়া পাখিদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে যে শেখ হাসিনা হল হয়েছে এ জায়গায় একটি পুকুর ছিল। এই পুকুরে অনেক পরীযায়ী পাখিরা আসতো। এই পুকুরটা ভরাট করাতে একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। লাইট একটা মেইন কারণ যে অঞ্চলটায় আলো থাকে সাধারণত পরীযায়ী পাখিরা ওই অঞ্চলটা পরিত্যাগ করে চলে । পরিমাণের তুলনায় বেশি আলো থাকার কারণে রাতের বেলা পোকামাকড় গুলো বের হয় না এর ফলে পাখিদের খাদ্য সংকটে ভুগতে হয়। রাজশাহীতে যে এত পরিমাণে লাইটিং হয়েছে তার কারণে আশেপাশে গাছগুলোতে যে পাখিগুলো ঘুমাতো আলোর জন্য তারা বাসস্থান চেঞ্জ করে ফেলে কারণ তারা তো অন্ধকার চায়।
ক্যাম্পাসে পশু পাখি নিয়ে কাজ করা রাবি সেভ ওয়াইল্ড লাইফ এন্ড ন্যাচারের সভাপতি ইমরুল কায়েস বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাখি যাওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আবাসস্থলের অভাব। বিগত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসের অনেক শতবর্ষী ও বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া জলাশয় গুলা অন্য কারণে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। তাই পাখিরা থাকার মত জায়গার অভাবে ভুগছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে ম্বচেতনতার অভাব রয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের দূষণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাখি শিকার পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখছে।তাছাড়া পাখিদের আবাসস্থলের দিকে মানুষের বেশি আনাগোনাও পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ায় ভূমিকা রাখছে।
আপনার মতামত লিখুন :