ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫

আজও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি গিরিশচন্দ্র সেন যাদুঘর

আল আমিন মুন্সী, নরসিংদী

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৯:১৪ পিএম

আজও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত  হয়নি গিরিশচন্দ্র সেন যাদুঘর

ছবি-বর্তমান বাংলাদেশ।

উদ্যোগ নেয়ার দীর্ঘ ৬ বছরেও দর্শানার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন যাদুঘর। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যায়ে তার পৈত্রিক বাড়ি নরসিংদীর পাঁচদোনায় নির্মাণ কাজটি চলমান থাকলেও প্রয়োজনী বরাদ্ধের অভাবে শেষ সময় নির্ধারণ হয়নি। 

 

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ককের পাশেই ভাই গিরিশ চন্দ্রের বাড়ি। বাড়িটির আশ পাশে বিভিন্ন স্থাপনা দিয়ে ঘিরে রাখার কারণে বুঝা যায়না এখানে একটি মহামানবের বাড়ি আছে। এর সামনেই রয়েছে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস। বাড়িটির পূর্ব পাশে আছে দখলদারত্বের কারণে মহাসড়ক থেকে দেখা মিলছেনা এই জাদুঘরটি। শুধু তাই নয় বাড়িটির আশ পাশে রয়েছে ময়লার স্তূপ। জাদুঘরের সামনে এসব পরিবেশ দেখে হতাশ দর্শনার্থীরা। 

 

তবে স্থানীয়দের দাবি- এ মহামানবের শেষ স্মৃতি বিজড়িত বাড়ির জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত করার পাশাপাশি ভাই গিরিশ চন্দ্রের সম্পত্তি সরকারি ভাবে উদ্ধার করা হোক।


ইতিহাস থেকে জানাযায়, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন ১৮৩৪ সালে নরসিংদী সদর উপজেলার পাচঁদোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু পরিবারে জন্ম হলেও তার সুনাম-সুখ্যাতির কেন্দ্র্র বিন্দু ছিল আরবি-ফার্সি ভাষার পান্ডিত্য জ্ঞান। ১৮৭১ সালে গিরিশ চন্দ্র সেন সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৭৬ সালে ৪২ বছর বয়সে তিনি মৌলভী এহসান আলীর কাছে আরবি ব্যাকরণ শিখেন। ৩ বছর কঠোর সাধনার পর ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায় গিরিশ চন্দ্র সেনই সর্বপ্রথম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র কোরআন শরীফের প্রথম পারা বাংলা অনুবাদ করেন, যা শেরপুর চারু চন্দ্র প্রেস থেকে ছাপা হয়। পরবর্তী সময়ে ৬ বছর কঠোর পরিশ্রম করে সম্পূর্ণ কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে অবাক করেন তিনি। তার প্রকাশিত ৩৫টি গ্রন্থের মধ্যে ২২টি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ ছিলো। ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। পরে নরসিংদীর পাঁচদোনা গ্রামের বাড়িতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। 

 

ঐতিহ্য অন্বেষণ সূত্রে জানা গেছে, গিরিশচন্দ্রের বাড়িটির মূল অবকাঠামো অক্ষুন্ন রেখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মেরামত ও সংরক্ষণের এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা ব্রিটিশ আমলের মূল্যবান কাঠ, আসবাবপত্র ও যশোরের টালি। এ ছাড়া, ঐতিহ্য অন্বেষণের নিজ উদ্যোগে উয়ারী-বটেশ্বর এলাকায় তৈরি করা একটি বিশেষ আয়তনের ইটও ব্যবহার ও নকশা অনুযায়ী নওগাঁ ও কুড়িগ্রামের পুরাকীর্তির কাজে অভিজ্ঞ ২০থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে এনেছে। 

এদিকে, পাশাপাশি গিরিশ চন্দ্রের বাড়িতে তৈরি করা হয়েছে একটি জাদুঘর। এখানে তুলে ধরা হয়েছে গিরিশ চন্দ্রের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও তার লেখা বই। 

 

নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও ঐতিহ্য অন্বেষণ এর সূত্রে জানাযায়, ইতিহাস-ঐতিহ্যে রকালেরস্বাক্ষী নরসিংদীতে রয়েছে পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিসচন্দ্র সেনের মত গুনিজনের পৈত্রিক ভিটা। অযত্ন অবহেলায় পরে থাকা প্রখ্যাত এই মহামানবের একমাত্র তার স্মৃতিচিহ্ন বাড়িটি প্রস্তুুত বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসন মিলে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িটিকে যাদুঘরে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে। 

 

২০০৮ সালে বাড়িটির মূল কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে সংস্কারে অনুদান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে ভারতীয় হাইকমিশন। পরে ২০১৫ সালে নরসিংদী জেলা প্রশাসন ও প্রত্নতাত্তিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় বাড়িটি সংরক্ষণ ও একটি প্রতœতাত্তি¡ক জাদুঘর নির্মাণের চুক্তি হয়।সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও দিক নির্দেশনায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হলেও নির্মাণ কাজ বাকী থাকায় পুরোদমে চালু হচ্ছেনা যাদুঘরটি। এটি পুরোদমে চালু হলে উন্মুক্ত হবে উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত এই মানুষটি সম্পর্কে জ্ঞান-ধারণা। ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়ির যাদুঘরটি দেখতে প্রতিনিয়তই ভিড় জমাচ্ছে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা। যাদুঘরটি সপ্তাহে কেবল শুক্র ও শনিবার ছাড়া বাকিদিনগুলো বন্ধ থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে দর্শনার্থীরা।


ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ির সামনে কথা হয় রাজধানীর খিলখেত থেকে ঘুরতে আসা খাদিজা জাকিয়ার সাথে তিনি বলেন, বই পুস্তক, ইন্টারনেটের মাধ্যমে গিরিশ চন্দ্র সেনের সর্ম্পকের কথা। বাস্তবে গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িটি প্রত্যক্ষ করার জন্য এখানে এসেছি। যদি ভিতরে গিয়ে দেখতে পারতাম তাহলে জাদুঘরের ভিতরের এই মহান ব্যক্তির অনেক অজানা তথ্য জানতে পারতাম। তালা দিয়ে রেখেছে যার কারনে যেতে পারিনি। এখানে এসে বাড়িটি দেখি ভালো লেগেছে কিন্তু পরিবেশটা খুব নোংরা। বাড়িটির চারপাশে ময়লা-আবর্জনা দিয়ে ভরা।

 

অচিন্ত পাল, নারু সেন ও মান্দার হোসেন বলেন, পবিত্র কোরআন শরীফের বাংলা অনুবাদ করা গিরিশ চন্দ্র সেন শুধু নরসিংদী বা বাংলাদেশে নয় সমগ্র উপমহাদেশেই একটি অতি পরিচিত নাম। কিন্তু বর্তমানে নতুন প্রজন্মরা ভুলতে বসেছেন উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত এই মানুষটিকে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন আমাদের অহংকার। আজ তারই বাড়ির সামনে ময়লার ভাগাড়, জমিদারের সন্তান হয়েও তার নামে মাত্র বাড়িটির জমিছাড়া অন্য কোন জমি তার নামে নেই। সব সম্পতি আজ ভুমি দখলদারদের হাতে। প্রশাসনে কাজে তাদের দাবি গিরিশ সেনের বাড়ির সকল সম্পতি যেন পূর্নরায় উদ্ধার করে একটি পূর্নাঙ্গ জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। 

 

ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. শাহীনুর মিয়া বলেন, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িটি বর্তমানে সরকার, প্রত্নত্তাতিক বিভাগ স্থানীয় প্রশাসন মিলে পরম মমতায় শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলছেন হারিয়ে যাওয়া গিরিশ সেনের বাড়ির ঐতিহ্য। তাদের উদ্যোগের কারনেই বাড়িটি পেয়েছে একটি নতুন রূপ। পুরোনো চেহারায় ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িতে করা হয়েছে একটি জাদুঘর।

 

তবে এ মহামানবের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে আসেন অনেকেই গিরিশধামে। নানা কারনে অযত্ন অবহেলায় তার বাড়িটি সকল সম্পতি ভুমি খেকো দখলে চলে গেছে। যারা গিরিশ চন্দ্র সেনের পাঠাগারের সাথে দীর্ঘদিন জড়িয়ে আছে তাদেরকে নিয়ে একটি কমিটি করে দিয়ে জাদুঘরটি সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। তাহলে আগামী প্রজন্মের,কাছে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের বাড়িটি একটি দর্শনীয় স্থান হবে বলে আমি মনে করি।


অচিরেই দ্বিতীয় দফায় বরাদ্ধ প্রাপ্তির ভিত্তিতে কাজ সম্পন্ন হলে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে যাদুঘরটি। সেই সাথে বাড়িটি ঘিরে অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

তবে এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরীর সাথে একাধিক মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করে নাই।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!