সন্তান ধারণে ব্যর্থ নারীদের অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর প্রতারক চক্র। এই চক্র ‘অলৌকিক’ গর্ভধারণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারী ও তাদের পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। চিকিৎসকের বেশে তারা ভুয়া ওষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে নারীদের মধ্যে গর্ভধারণের অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে। এরপর দাবি করে, ভ্রূণটি জরায়ুর বাইরে বেড়ে উঠছে।
এমনই প্রতারণার শিকার চিওমা নামের এক নারী। ভুক্তভোগীর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি ১৫ মাস গর্ভবতী ছিলেন এবং একটি ছেলে শিশুর জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু তার শ্বশুরবাড়ির মানুষ শিশুটিকে তাদের জৈবিক সন্তান বলে মেনে নিতে রাজি নয়।
কোনো কোনো ভুক্তভোগী নারী বিশ্বাস করেন তার গর্ভাবস্থার সময় ছিল প্রায় দুই বছর। এমন সব ঘটনা ঘটেছে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়ার আনামব্রা রাজ্যে। দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ক্যারিবিয়ান অঞ্চল এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় এমন বহু প্রতারক চক্র।
প্রতারক চক্রের ভুয়া চিকিৎসকরা নারীদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা ‘অলৌকিক চিকিৎসার’ মাধ্যমে গর্ভধারণ করাতে সক্ষম। প্রথম পর্যায়ে নারীদের যৌনাঙ্গে ইনজেকশন ও ওষুধ দিয়ে শরীরে গর্ভবতী হওয়ার উপসর্গ তৈরি করা হয়। এ সময় পেট খানিকটা ফুলে ওঠে, যেন মনে হয় জরায়ুতে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে তার কোমল শিশুটি। এ সময় তাদের মূলধারার হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের কাছে না যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বলা হয় আল্ট্রাসোনোগ্রাম না করাতে। নির্দেশনা দেওয়া হয়, গর্ভধারণের প্রতিটি ধাপ দেখতে হলে নিয়মিত ফি দিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে।
যখন প্রসবের সময় হয়, তখন বিশেষ ওষুধ দেওয়ার নামে আরো বেশি অর্থ দাবি করে প্রতারক চক্র। এই ভুয়া প্রসবের সময় নারীদের অ্যানেস্থেশিয়ার মাধ্যমে অজ্ঞান করে সেখানে সংগৃহিত একটি নবজাতককে এনে দেওয়া হয়, যাকে ঐ নারীর গর্ভজাত সন্তান বলে বিশ্বাস করানো হয়।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির আফ্রিকা আই টিম এই প্রতারণার তদন্ত করতে গিয়ে ডা. রুথ নামে এক ভুয়া চিকিৎসকের সন্ধান পেয়েছে। তিনি একটি পুরোনো হোটেলে নিজস্ব ক্লিনিক চালান, যেখানে অনেক নিঃসন্তান নারী স্বপ্ন নিয়ে জড়ো হন। বিবিসি টিম জানতে পারে, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক নারীর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নাইরা বা ২০৫ ডলার সমপরিমাণ অর্থ নেয়া হয়। পরবর্তী পর্যায়ে শিশুর জন্মের জন্য দাবি করা হয় ১৫-২০ লাখ নাইরা বা ১ হাজার ১৮০ মার্কিন ডলার।
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আনামব্রা রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি অবৈধ ক্লিনিকে অভিযান চালায়। সেখানে বেশ কয়েকজন গর্ভবতী নারীকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয় এবং তাদের সদ্যজাত শিশুকে এই চক্র ওই সব নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দিয়ে দেয়। উদ্ধারকৃত নারীদের মধ্যে অনেকে আর্থিক চাপে পড়ে বা ভয় পেয়ে এই চক্রে যুক্ত হন।
চিওমার ঘটনা নিয়ে কমিশনার ইফি ওবিনাবো বিশদ তদন্ত করেন। চিওমাকে তিনি নবজাতকটির জৈবিক মা হিসেবে স্বীকৃতি দেন, তবে সতর্ক করেন যে আসল অভিভাবক এলে নবজাতকটিকে ফেরত দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে নারীদের প্রতি সামাজিক চাপ, বন্ধ্যাত্বের প্রতি কুসংস্কার এবং প্রজনন অধিকার নিয়ে সঠিক ধারণার অভাব এসব প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ ধরনের ঘটনা রোধে নারীদের সচেতনতা বাড়ানো এবং সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। এ ধরনের প্রতারণা শুধুমাত্র সামাজিক চাপে থাকা নারীদের দুঃখকেই বাড়িয়ে তোলে না, বরং মানবপাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধের পথও বিস্তৃত করে।
আপনার মতামত লিখুন :