ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

গ্রাহকের ৪২ লাখ টাকা আত্মসাত, নিশ্চুপ ব্যাংক এশিয়া

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২৪, ০৭:৪২ পিএম

গ্রাহকের ৪২ লাখ টাকা আত্মসাত, নিশ্চুপ ব্যাংক এশিয়া

গ্রাহকের একাউন্ট থেকে স্ত্রীর একাউন্টে ১০ লাখ টাকা ট্রান্সফার করেছেন এজেন্ট মালিক আতিকুল ইসলাম, অথচ বিষয়টি জানেন না গ্রাহক। উল্টো আতিকুল ইসলামের তোপের মুখে পড়তে হয়। এমনকি গ্রাহককে ভুলভাল বুঝিয়ে ভুয়া স্টেটমেন্ট দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য গোপনও করেছেন আতিকুল ইসলাম। যা সম্পর্কে অবগত নন গ্রাহক। এমন সব অভিনব পন্থা অবলম্বন করে দ্বীন মোহাম্মাদ নামের এক গ্রাহকের ৪২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট আতিকুল ইসলাম। বর্তমানে তার চারটি এজেন্ট শাখা রয়েছে।

সূত্র বলছে, ব্যাংক এশিয়ার প্রধান কার্যালয়ে দ্বীন মোহাম্মাদসহ আরও ৭২ জন অভিযোগ করেছেন আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। যার সবই অর্থ আত্মসাত নিয়ে। গ্রাহকদের এসব অর্থ আত্মসাত করে বর্তমানে তিনি চারটি এজেন্ট শাখার মালিক বনে গেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে বিষয়টি সম্পর্কে প্রধান কার্যালয় অবগত হলেও কোনো সুফল পাননি গ্রাহকরা। প্রধান কার্যালয়ে থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ না করায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। আর এসব অর্থ আত্মসাতে প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে মানিকদি শাখার ক্যাশিয়ার সানজিদার বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক এশিয়ার ক্যান্টনমেন্টের মানিকদি বাজার ব্যাংক এশিয়ার শাখায় একটি একাউন্ট খোলেন তিনি। একাউন্টে রেখেছিলেন মোটা অংকের টাকা। যা দিয়ে করছিলেন বাড়ি নির্মাণের কাজ। তবে হঠাৎ করেই তিনি জানতে পারেন তার একাউন্টে টাকা নেই। এরপর আতিকুল ইসলামের কাছে থেকে স্টেটমেন্ট তুলে টাকা না থাকার তথ্য পান তারা। তবে স্টেটমেন্ট যে ভুয়া ছিল সেটা সম্পর্কে সেসময় জানতেন না দ্বীন মোহাম্মাদ। পরবর্তীতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে স্টেটমেন্ট তুলে সেটার সত্যতা পান তারা।

দ্বীন মোহাম্মাদ বর্তমান বাংলাদেশকে বলেন, ‘আতিকুল ইসলাম আমাকে ব্যাংক ডেকে হাতের ছাপ নিয়েছে। সে বলে চাচা সার্ভারে সমস্যা হয়েছে একটু ব্যাংকে আসেন। এই বলে একটা হাতের ছাপের বদলে তিনটা করে ছাপ নিতো। এভাবেই সে আমার টাকাগুলো নিয়ে নিয়েছে।’

তথ্য বলছে, আতিকুল ইসলাম এবং সানজিদা বেগম স্বামী-স্ত্রী। এজেন্ট শাখা খোলার আগে আতিকুল ইসলাম ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট শাখায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সহজ-সরল এবং মেধাবী। তবে সেই মেধা তিনি চাকরি জীবনে দেখিয়েছেন। চাকরি জীবন ছেড়ে দেওয়ার পর ২০ লাখ টাকা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দিয়ে হয়ে উঠেন একটি শাখার মালিক। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে খুলে যায় তার জীবনের অধ্যায়। কাঁচা টাকার গন্ধে হয়ে উঠেন মরিয়া, গড়ে তোলেন আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক এশিয়ার চারটি এজেন্ট শাখা রয়েছে আতিকুল ইসলামের। এছাড়াও একটি স্বপ্ন সুপার শপের অর্থেক মালিকানা রয়েছে তার।

অভিযোগ রয়েছে, তথ্য গোপন করে স্টেটমেন্ট বানিয়ে দ্বীন মোহাম্মাদের টাকা হাতিয়ে নেন আতিকুল ইসলাম। যার স্টেটমেন্টের কপি সংরক্ষণ রয়েছে। যেখানে গ্রাহকের দশ লাখ টাকা গোপন করেছেন তিনি। গোপন করা সেই টাকা ২০২১ সালে ২৯ এপ্রিল অন্য একটি একাউন্টে ট্রান্সফার করেন তিনি। গ্রাহকের অনুমতি না নিয়ে টাকা ট্রান্সফার করা অর্থ আত্মসাতের শামিল। সেই কাজটিই নিজের মনে করে করেছেন আতিকুল ইসলাম। ব্যাংক এশিয়ার প্রধান কার্যালয় থেকে দীন মোহাম্মদের একাউন্টের স্টেটমেন্টের কাগজ তুলে ১০ লাখ টাকা গোপনের সত্যতা পাওয়া যায়। যার কাগজ সংরক্ষণ রয়েছে।

এ বিষয়ে আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

সূত্র বলছে, দ্বীন মোহাম্মাদের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যাংক এশিয়া। যেখানে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার সত্যতা পায় তদন্ত কমিটি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তবে এখনও এই ঘটনার কোনো অগ্রগতি নেই। দায়িত্ব অবহেলা আর উদাসীনতার মারপ্যাঁচে আটকে আছে ভুক্তভোগীর টাকা।

ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের কর্মকর্তা রুহুল মতিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আতিকুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। ভুক্তভোগী দ্বীন মোহাম্মদকে আমরা কয়েকবার অফিসে ডেকেছিলাম। আতিকুল ইসলাম এবং দ্বীন মোহাম্মদ এদের দুজনকে আমরা একসাথে পাচ্ছি না। গত দুই মাস ধরে তাদের সমস্যা সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল মতিন আরও বলেন, ‘আতিকুল ইসলামের চারটি শাখা থেকে মোট ৭২টি অভিযোগের বিষয়টি সত্য। আমরা অস্বীকার করবো না। এসব অভিযোগের বিষয়ে অনেক অভিযোগ আতিকুল ইসলাম একাই সমাধান করেছেন। আমরা দ্বীন মোহাম্মাদের বিষয়ে কাজ করছি।’

দ্বীন মোহাম্মাদের ব্যাংক স্টেটমেন্টের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ৩১ মার্চ নিজের একাউন্ট থেকে ২০ হাজার টাকা তোলেন তিনি। একই বছরের ১২ এপ্রিল আবারও ১০ হাজার টাকা তোলা হয়। সে সময় তার ব্যাংকে অবশিষ্ট টাকা থাকে ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শত ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু ২৯ এপ্রিল ১০৮৩৩২৬০০১৬৮৫ একাউন্টে ১০ লাখ টাকা ট্রান্সফার করার তথ্য আতিকুল ইসলাম গোপন করে স্টেটমেন্ট দেন দ্বীন মোহাম্মাদকে। অবশিষ্ট ২১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শত ৯২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০ লাখ টাকা গোপন করা হলেও একই তারিখে স্টেটমেন্টে ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৯শ ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দেখানো হয়েছে।

ভোক্তভোগীর আত্মীয়রা জানান, বাড়ির কাছে এজেন্ট ব্যাংক হওয়ায় আতিকুল ইসলামের সাথে দ্বীন মোহাম্মাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। এমনও সময় গেছে টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন কিন্তু তিনি রশিদ নেয়নি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন আতিকুল ইসলাম।

দ্বীন মোহাম্মাদের নাতি তাসকিন আহমেদ বর্তমান বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার নানা সহজ-সরল মানুষ। ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা তিনি জমা দিতেন বিশ্বাসের ওপর। বয়স বেশি হওয়ায় সবকিছু মনে রাখতে পারতেন না। ভাতিজাকে সঙ্গে করে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসতো। কিন্তু আতিক এইভাবে টাকাগুলো নয়ছয় করল আমরা দেরিতে জানতে পেরেছি।’

তাসকিন আহমেদ আরও বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। সেই তদন্তে আবার টাকা নয়ছয় করার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু গত দুই বছর হচ্ছে ব্যাংক এশিয়ার হেড অফিস আতিকুল ইসলামের কাছে থেকে টাকা তুলে নিয়ে দিচ্ছে না।’

ব্যাংক এশিয়ার তথ্যমতে, এজেন্ট ব্যাংকে টাকা জমার করার সময় গ্রাহককে কোনো রশিদ দিতে হয় না। শুধু টাকা জমা দিলে এজেন্ট পয়েন্ট থেকে গ্রাহককে প্রিন্টেড রশিদ দেন কর্মকর্তারা। তবে দ্বীন মোহাম্মাদের ক্ষেত্রে হয়েছে ভিন্ন। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট দুটি ডিপোজিট রশিদে ব্যাংকে সাড়ে সাত লাখ টাকা জমা করা হয়। একটিতে আড়াইল লাখ, অন্যটিতে পাঁচ লাখ টাকা। ব্যাংক থেকে জমা করা টাকার রশিদে সিল স্বাক্ষর করা হয়। তবে পরবর্তীতে এই দুই রশিদকে নকল বলে দাবি করেন আতিকুল ইসলাম।

এ বিষয়ে তাসকিন আহমেদ বলেন, ‘যখন টাকার বিষয়ে অস্বীকার যান আতিকুল ইসলাম। তখন অডিট শুরু হয়। অডিটের রিপোর্টেও সত্যতা মিলেছে। এরপর ম্যানেজারের কাছে আমরা টাকা চাইতে গেলে প্রমাণ চান। আমরা যখন রশিদ দেখাই তখন আতিক বলেন এই রশিদ নাকি ভুয়া।’

ভুক্তভোগীর আত্মীয়রা আরও জানান, ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দ্বীন মোহাম্মাদের একাউন্টে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা করা হয়। এদিন আলাদাভাবে আরও ২০ লাখ টাকা নিয়ে রেজাউল করিম লিটন নামের এক আত্মীয় নিয়ে আতিকুল ইসলামের কাছে যান দ্বীন মোহাম্মাদ। নগদ ২০ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। কিন্তু টাকা জমার বিষয়টি প্রথমে স্বীকার করলেও পরবর্তীতে তা অস্বীকার করেন রেজাউল করিম লিটন এবং আতিকুল ইসলাম। রেজাউল করিম লিটন সম্পর্কে দ্বীন মোহাম্মাদের ভাতিজা। রেজাউল করিম লিটনই এই টাকা আত্মসাতের বিষয়ে সরাসরি জড়িত বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!