ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার পরিবারের বউমা এবং দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী শারমিন আকতারকে এবার গাজীপুরে পদায়ন করা হয়েছে।
জানাগেছে, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট হাসিনার পদত্যাগ এবং পলায়নের পর নির্বাহী প্রকৌশলী শারমিন আকতারকে গত ১৩ আগস্ট ওএসডি করা হয়েছিলো। কিন্তু কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে উল্ট করা হয় পদায়ন।
সূত্র বলছে, ওএসডি করার ১৫ দিন পরই আবার তাকে উত্তরা এ্যাপার্টম্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পে বদলি করা হয়। এসব দেখে শারমিন আক্তারের স্বামীই ইঞ্জিনিয়ার জুয়েল রাতারাতি ভোল পাল্টে জাতীয়তাবাদী ঘরানায় চলে আসে।
অভিযোগ রয়েছে, শারমিন আকতার মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে কর্মরত অবস্থায় তার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জুয়েল ও ওই কার্যালয়ের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম বাকী ইবনে হাফিজকে সাথে নিয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। বিশেষ করে তার স্বামী প্রকৌশলী হওয়ার কারণে মেসার্স বাবর এসোসিয়েটস ও এসএ এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার করে নিজেই ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সুত্রমতে,‘বিভিন্ন কাজে ঠিকাদারের কাছে মোটা অংকের কমিশন নেওয়াই ছিল গোপালগঞ্জের এই প্রকৌশলীর কাজ। কমিশন ছাড়া প্রকল্পের ফাইল ছাড় করতেন না তিনি -এটা ডিপার্টমেন্টের সবাই জানে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকেই মানিকগঞ্জ গনপূর্ত বিভাগকে অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিণত করেন তিনি।’
দায়িত্ব গ্রহণের এক সপ্তাহ পরেই এসপি অফিসের কাজের দরপত্র আহবান করেন, (আইডি ৭৭১৪০৮) পিপিআর লঙ্ঘন করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এই দরপত্রটিতে অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারদের মাত্র ৪৪ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টেন্ডার আইডি নং ৯৯৬৮৫৬, ১৯৭৪৩৭, ১৯৭৪৩৪সহ অসংখ্য দরপত্রে পিপিআরের আইন-কানুন অনুসরণ করেন এই প্রকৌশলী। এর মধ্যে- টেন্ডার আইডি নং ১৯৮৪৬৪, ১৯৮৪৬০, ১৯৮৪৫৬সহ বেশ কিছু দরপত্র চলতি বছরের ১১ জুন সন্ধ্যা পৌনে ৬টা থেকে ওইদিনেরই রাত ১০টা পর্যন্ত- মাত্র ৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হয় এবং পরিকল্পিত অনুযায়ী অনিয়ম করে নিষ্পত্তি করা হয়।
স্থানীয় ঠিকাদারদের অভিযোগ, ব্যাংকিং আওয়ার ছাড়া টেন্ডার নিষ্পত্তি করার উদাহরণও তৈরি করেছেন প্রকৌশলী শারমিন আকতার। একটি দরপত্রে ব্যাংকিং আওয়ার ছাড়াই সন্ধ্যা ৫টা ৪৫ মিনিট থেকে রাত দশটা পর্যন্ত টেন্ডার লাইভে রেখে নিষ্পত্তি করেন। অনিয়ম করে খোলা সেই টেন্ডারের বিপরীতে ওয়ার্ক অর্ডারও ইস্যু করেন তিনি। অথচ পিপিআর ২০০৮ অনুসারে ওই টেন্ডার করা কোনোভাবেই নিয়মের মধ্যে পড়ে না।
তারা জানান, ২০২৩ সালের জুন মাসে শেষ হয় মানিকগঞ্জ সমন্বিত অফিস ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। কিন্তু সেই কাজ উদ্বোধন করা হয়েছিলো ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর । অথচ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার মাত্র এক মাস আগেও পিডি অফিসের ফার্নিচার ক্রয়ের টেন্ডার করা হয়। মাত্র এক মাসের জন্য যে কোনো পিডি ফার্নিচার ক্রয় করবেন না সেটা সবারই জানা।
খোজ নিয়ে দেখা যায়, এই টেন্ডারের মাধ্যমে ক্রয় করাই হয়নি পিডি অফিসের কোনো ফার্নিচার। এমনকি প্রকল্প পরিচালক অন্ধকারে রেখে ফার্নিচার ক্রয়ের নামে লুটপাট করা হয় টাকা।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য অনুযায়ী পুরো টাকা ঠিকাদার ও এই সিন্ডিকেট ভাগাভাগি করে মেরে দেন। ওই এলাকার ঠিকাদাররা এর প্রতিবাদ করলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই শেখ সেলিম মানিকগঞ্জের আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে ঠিকাদারদের বিভিন্ন হুমকি ধামকি প্রদান করেন। পরবর্তীতে ভয়ে স্বামী-স্ত্রীর কর্মকাণ্ড সহ্য করতে বাধ্য হন সবাই।
এদিকে, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম বাকী ইবনে হাফিজ ও নির্বাহী প্রকৌশলী শারমিন আকতারের এসব দুর্নীতিসহ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের টেন্ডারে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
অভিযোগটি করেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর কবির হোসেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদী ‘গোপালী সচিব’ শারমিন আকতারের সকল অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দেন। ফলে বেঁচে যান শারমিন আকতার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।
সাব রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাজটি ভিন্ন একটি কোম্পানির নামে ওয়ার্ক ওর্ডার হলেও মাঠ পর্যায়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বামী ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জুয়েলের দ্বারাই বাস্তবায়ন করা হয়।
স্থানীয় ঠিকাদাররা জানান, গত দেড় বছরে এই চক্রটি বিভিন্ন কোম্পানির ঠিকাদারী লাইসেন্স ব্যবহার করে মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগ চালায় উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী গোলাম বাকী ইবনে হাফিজ ও নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বামী জুয়েল।
ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ জুয়েলের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা এম এম জুবায়ের আহমেদ সজীবের চাচাতো ভাই এবং ফ্যাসিবাদী হাসিনার পরিবারের একজন সদস্য।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট হাসিনার পদত্যাগ এবং পলায়নের পর শারমিন আকতারকে গত ১৩ আগস্ট ওএসডি করা হয়েছিলো। এর ১৫ দিন পর আবার তাকে উত্তরা এ্যাপার্টম্যান্ট নির্মাণ প্রকল্পে বদলি করা হয়। এসব দেখে শারমিন আক্তারের স্বামীই ইঞ্জিনিয়ার জুয়েল রাতারাতি ভোল পাল্টে জাতীয়তাবাদী ঘরানায় চলে আসে।
কিন্তু, এখনো তার ফেসবুক ওয়াল ঘুরছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বদনাসহ বিএনপি মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার নামে কুরুচিপূর্ণ পোস্ট ।পরবর্তীতে কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় এই ফ্যাসিবাদের দোসরকে গত ৩ অক্টোবর গাজীপুরের গণপূর্ত বিভাগে পদায়ন করা হয়।
তার এমন পদায়নে ক্ষোভ বেড়েছে গাজীপুরের জনমনে। তাদের প্রশ্ন, অন্তর্বর্তী সরকারের আবরণের নিচে সৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের অপসারণের মাঝে এসব দোসরদের পূর্নবহালের কাজটি যারা করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। না হয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সম্ভব হবে না।
এদিকে, এসব বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী শারমিন আকতারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করতে গেলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
আপনার মতামত লিখুন :