ঢাকা শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫

জেল থেকে বেরিয়ে বলছি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪, ০৯:০৮ পিএম

জেল থেকে বেরিয়ে বলছি

ছবি- বর্তমান বাংলাদেশ।

* কারাগারে সিআইডিদের নির্যাতন

* টাকা দিলেই মেলে সেবা  

* টাকায় সাধারণরাও হয়ে যান ভিআইপি

* কারা কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই চলে দুর্নীতি

 

টাকা দিলেই যেখানে সাধারণ মানুষও হয়ে যান ভিআইপি। সাধারণ বন্দি হয়েও ভোগ করেন ভিআইপি সুবিধা। টিভি, ফ্রিজসহ থাকেন নিরিবিলি রুমে। ইচ্ছে হলেই ভর্তি হন হাসপাতালে! বিলাসিতার কমতি নেই সেখানেও। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সামনে থাকে ল্যাপটপ।

ভেতরে থেকেই যোগাযোগ করেন মোবাইলে। বন্দি ঘরে থেকেই পরিচালনা করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। আবার ভেতরে বসেই মোবাইলে চালিয়ে যাচ্ছেন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

বন্দিরা বলছেন, ভেতরে নিষেধাজ্ঞা থাকা সবই চলে টাকার বিনিময়ে। টাকা দিলেই সব সম্ভব হয় এখানে। এমন কর্মকাণ্ডে বোঝা দায় তারা বাসায় না কি কারাগারে। এসব সুবিধা নিতে গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। কিন্তু জেল কোডে এসবই ছিল নিষেধ। 

বন্দির স্বজনদের অভিযোগ, কারাগারে টাকা দিলে সবই সম্ভব। ভালো খাবার, ঘুমানো, মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে সবই টাকার বিনিময়ে নিতে হয়।

এভাবেই প্রতিবেদকের কাছে বলছিলেন, বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে জামিনে বেরিয়ে আসা বন্দিরা।     

বলছিলাম, কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের অনিয়ম-দুর্নীতির কথা। বন্দিদের কথায় বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর সবতথ্য।  

বন্দিদের ভাষ্যমতে, টাকা ছাড়া কারাগারে কোন সেবা মিলে না। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভেতরে ব্যবহার করা যায় অ্যান্ড্রয়েট মোবাইল। এসব সুবিধার জন্য সপ্তাহে কিংবা মাসে সিন্ডিকেটের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করতে হয়। সেই সিন্ডিকেটে পুরোনো বন্দিদের সঙ্গে রয়েছে কিছু অসাধু কারারক্ষী ও কর্মকর্তা। আবার কারারক্ষী ও পুরোনো বন্দি সিন্ডিকেটকে সাহস দিচ্ছেন কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।  

কিন্তু এই সুবিধাগুলো ভোগ করতে নিজের কাছে রাখতে হয় ২০-৩০ হাজার টাকা। অপরাধ বুঝে বেড়ে যায় টাকার অংক। এর সবই দেখেছেন বন্দিরা।   

কারাগারের ভেতরের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের এক নারী কারারক্ষী জানান, ‘কারাগারের ভেতরে টাকা দিলে যেকোন সুবিধা পাওয়া যায়। মাদক থেকে শুরু করে অন্ধকারে সব চলে। জেল কোডে সাধারণ বন্দি হওয়ার পরেও টাকার বিনিময়ে ভিআইপি সুবিধা ভোগ করে দিনের পর দিন।’  

তিনি বলেন, ‘এগুলো দেখে নিজেকে খুব অপরাধ বোধ মনে হয়। কিন্তু কিছু করার নেই। ছোট চাকরি করি চাইলেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি না। মুখ বন্ধ করে শুধু দেখে যেতে হয়।’

কারাগারের ভেতরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাজত্ব দেখার একজন বন্দি মো. এস (ছদ্মনাম)। আমরা এখানে নিরাপত্তার স্বার্থে ভুক্তভোগির নামের প্রথম অক্ষর ব্যবহার করেছি। তিনি দেশের একটি আলোচিত মামলায় প্রায় আড়াই বছর কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন।

মো. এস। কারাগারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, ইমন, ঈদুল, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মহাখালীর সেলিম ওরফে লুম্বু সেলিম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, কিলার আব্বাস ও ফ্রিডম সোহেলদের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সান্নিধ্যে। কারাগারে তাদের রাজত্ব দেখেছেন তিনি। যাদের কয়েকজন এখন জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।

মো. এস বলেন, ‘নিজের চোখে দেখেছি সেই সন্ত্রাসীরা ভেতরে থেকে মোবাইলের মাধ্যমে বাইরের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। তারা এখন বাইরের থেকে ভেতরে বসেই নিরাপদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।’  

কারাগারে তাদের ক্ষমতা কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক কথায় কারাগার তাদের ঈশারাতেই চলে। ভিআইপি রুম, অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর মেডিকেল সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন তারা। টিভি, ফ্রিজ কি নেই সেখানে। তাদের সহযোগিতায় আমি নিজেও অ্যান্ড্রয়েট মোবাইল ব্যবহার করেছি।’

অপরএক আসামি মো. কাদের (ছদ্মনাম)। তিনি একটি মামলায় ২২ মাস অর্থাৎ ২ বছর ৪ মাস (কারাগারে ৯ মাসে এক বছর) কারাভোগ করে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জামিনে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘ এই ২২ মাসে দেখেছেন কারাগারের ভেতরের নানা নিয়ম-অনিয়ম।

তার চোখে দেখা, কারাগারের ভেতরে দেশের পরিচিত সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, বিভিন্ন অপরাধে বন্দি সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের বিলাসী জীবনযাপন। কারাগারে পুরোনো কয়েদিদের সিন্ডিকেট ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আধিপত্য নিয়ে কথা বলেছেন বর্তমান বাংলাদেশের সাথে।

মো. কাদের জানান, ‘আমি নিজেই কারাগারে অ্যান্ড্রয়েট মোবাইল ব্যবহার করেছি। সেই মোবাইলের মাধ্যমে কারাগারে বসেই পরিবার ও স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করেছি। সেজন্য সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিতে হয়েছে এককালীন ১০ হাজার টাকা। কিন্তু খুব গোপনে ব্যবহার করতে হত। কারণ সিআইডির চোখে ধরা পড়লে শারীরিক নির্যাতন থেকে বাঁচতে দিতে হয় ২০-৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও, প্রতি সপ্তাহে ও মাসে কারারক্ষীদের মোবাইলে বিকাশে টাকা এনেছি। বিনিময়ে কারারক্ষীদের হাজারে ২০০ টাকা কমিশন দিতে হয়।’  

২০-৩০ হাজার টাকা কেন রাখতে হয় জানতে চাইলে মো. কাদের জানান, ‘কারাগারে সিআইডি কর্মকর্তাদের নজরে পড়লে শারীরিক নির্যাতন করা হত। ধরা পড়লে ওদের ২০-৩০ হাজার টাকা দিয়ে দিলে আর কিছু বলে না। এক কথাই ইজারাদাররা সুবিধা দেয় ঠিকই আবার টাকা নেয়ার জন্য তার পেছনে সিআইডি লাগিয়ে দেয়।’

কারাগারে সিআইডি কারা?

মো. কাদের ও অন্য বন্দিদের ভাষ্যমতে, এখানে যারা সিআইডি হিসেবে রয়েছেন তারা কেউ পুলিশের সদস্য না।

বন্দিরা বলছেন, পুরোনো কয়েদি, সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বা হাজতি যাই বলেন, এরাই মূলত সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ইজারাও তারাই নেন। সেখানে সিন্ডিকেট থেকে বাছাই করে কিছু সদস্যদের বানানো হয় সিআইডি। তাদের কাজ কোন বন্দি কি করছেন সেটি গোপনে লক্ষ্য রাখা এবং সিন্ডিকেট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করা। মূলত পুরোনো কয়েদিদের ভেতর থেকেই বানানো হয় সিআইডি।

জুয়েল রানা নামের একবন্দি জানান, ‘টাকার বিনিময়ে কারাগারে বসেই চলে নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড। টাকা দিলেই মানসম্মত থাকা ও খাবার সুবিধা, বিশেষ ভাবে দেখা করার সুবিধা পাওয়া যায়। ইজারাদারদের সহযোগিতা নিয়ে মাদকসেবন, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অনিয়ম দুর্নীতি চলে কারাগারে।’

তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালী বন্দিদের চলে রামরাজত্ব। কেউ যেন বলার নেই। আবার কেউ কেউ মোবাইল ব্যবহার করে কারাগারে বসেই চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা-বাণিজ্য। টাকা দিয়েই সব কিনে রাখেন তারা।’

অন্যদিকে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চালিয়ে যাচ্ছেন বাইরের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও। কারাগারে সাধারণ বন্দি হয়েও বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এজন্য শুধু গুণতে হয় বাড়তি টাকা। টাকা থাকলেই কারাগারে মেলে বিলাসিতা। বাইরের প্রায় সব সুবিধা পাওয়া যায় কারাগারে বসেই।  

অপরএক বন্দি ইমরান জানান, ‘টাকার বিনিময়ে কারাগারে সাধারণ বন্দিরা সব সুবিধা পেতে পারেন। আমি নিজেই দেখেছি সামাজিক ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কারাগারে বসে বাইরে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। মোবাইলে নির্দেশনা দেন কারাগারে বসে। আমার মনে হয়েছে তারা বাইরের থেকে কারাগারেই নিরাপদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।’

সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সিন্ডিকেটের সদস্যরা যত অনিয়ম করে তার সবই জানে জেল কর্তৃপক্ষ। তাদের ম্যানেজ করেই বন্দিদের থেকে নানা অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। যাদের টাকা আছে তাদের কাছে কারাগার বাসা-বাড়ির থেকেও নিরাপদ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বর্তমান বাংলাদেশকে বলেন, ‘কারাগারে টাকা দিলেই অনেক কিছু করা সম্ভব। আইনে বা বিধানে থাকুক বা না থাকুন। যেমন; ভালো খাবার ব্যবস্থা করা, মোবাইলে কথা বলার সুযোগ করে দেয়া। এর বাইরেও অনৈতিক কিছু চাহিদা সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে টাকার বিনিময়ে।

তিনি বলেন, কারাগারের বন্দি জীবনে কয়েদিরা বা বন্দিরা কী করতে পারবেন কী পারবেন না সেটি কিন্তু কারা আইনে বা বিধানে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছেন। তার পরেও কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে কারাগারে দুর্নীতি চলছেই।

এসময় চট্রগ্রাম কারাগারের একটি ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি কারাগারের ভেতরে বোর্ড মিটিং করেছে। আবার জুম বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যবসায়িক মিটিং ও করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। 

কারাভোগ করে বেরিয়ে আসা বন্দিদের ভাষ্য বা গণমাধমে উঠে আসা বন্দিদের জবানবন্দির কথা তুলে ধরে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘জেল কোডে সাধারণ বন্দি হয়ে ও ভিআইপি সুবিধা পাচ্ছেন অর্থবিত্তভাবে প্রভাবশালীরা। যা একদম অপরাধ।’  

কারা কর্তৃপক্ষের সু-ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘সেখানে যদি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী বা কারা কর্মকর্তারা দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পরেন তাহলে তো তাদের যে স্লোগান ‘রাখিব নিরাপদে, দেখাব আলোর পথ।’ আলোর পথ দেখানো সম্ভব না। কারা কর্তৃপক্ষের সু-ব্যবস্থা বাস্তবায়ন না হলে। অর্থের বিনিময়ে সুবিধা দেওয়া বন্ধ না করলে কগজে কলমেই থেকে যাবে স্লোগান।’  

কারাগারের ভেতরের এমন অনিয়ম দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, ‘কারাগারে পুরান কয়েদি (সিআইডি) কর্তৃক নির্যাতনের ঘটনা সঠিক। আবার কিছু অসাধু কারারক্ষীরা টাকার বিনিময়ে সুবিধা দিয়ে থাকেন। আবার তেমনই টাকা না দিলে নির্যাতনও করে সব অভিযোগই সত্য। তবে এই অন্যায়গুলো আর থাকবে না।  আমি এসেই এগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি। দ্রুতই সমাধান হবে।

 

 

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!