ঢাকা শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫
আবু সাঈদ হত্যা

ময়না তদন্তের রিপোর্ট বদলাতে চাপ সৃষ্টি করেছিল সরকার

রংপুর ব্যুরো

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৩:৫৮ পিএম

ময়না তদন্তের রিপোর্ট বদলাতে চাপ সৃষ্টি করেছিল সরকার

ছবি-সংগৃহীত

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বদলাতে চিকিৎসককে চাপ দিয়েছিল সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের গুলিতে নয় বরং মাথায় আঘাত পেয়ে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে এমন রিপোর্ট চেয়েছিল তারা।

এবার এমন বিস্ফোরক তথ্য সামনে এনেছেন আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের   ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম।

আবু সাঈদ নিহত হবার দুই মাস আট দিন পর প্রকাশ পেয়েছে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। তবে এই চিকিৎসকের দাবি তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গত ৩০ জুলাই এ প্রতিবেদনটি জমা দেন।

তিনি বলেন,‍‍`ওই সময় আমি প্রচন্ড চাপে ছিলাম। দেশের অবস্থা তখন খারাপ ছিল সরকারও খুব এগ্রেসিভ ছিল। আমাকে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছিল যেন যেকোনোভাবে আমি ইয়ে (গুলিতে মৃত্যু) না দেখাই। কিন্তু আমি আমার দিক দিয়ে খুব অনোর ছিলাম। কলেজ প্রশাসন আমার পক্ষে ছিল যার কারনে আমি যে রিপোর্ট পেয়েছি সেটি দিয়েছি।

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কেন পরিবর্তন করতে চেয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান,আবু সাঈদের মৃত্যু মাথায় ইনজুরি কিংবা অন্য কারণে হয়েছে বলে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট যেন দেয়া হয় এমনটিই ছিল সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এটা হয়নি আমরা ময়নাতদন্তে যা পেয়েছি রিপোর্টে তা দেয়া হয়েছে।

ময়নাতদন্ত রিপোর্টে যা আছে

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে চিকিৎসকরা তাদের মন্তব্যে জানিয়েছেন আবু সাঈদের নিহতের ঘটনাটি হোমিসাইডাল বা হত্যাকান্ড।

অসংখ্য ছররা গুলির আঘাতে আবু সাঈদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় এবং তার অভ্যন্তরীণ অঙ্গের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে কিন্তু সেটি তার মৃত্যুর কারণ নয়।

এছাড়া ডান উরুতে ছররা গুলি লাগার কারণে সেখানে ফিমোরাল আর্টারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়। তলপেটেও

 গুলির আঘাত ও রক্তক্ষরণ পেয়েছি। এসব আঘাতের কারণে শক ও রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে। তার মাথায় একটা আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি। আঘাতটা থেতলে যাওয়ার মতো কিছুটা পড়ে গিয়ে বা আঘাতে হতে পারে। এটা মেজর হেড ইনজুরি মনে হয়নি। হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হলে ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হতো, যেটা সাঈদের ক্ষেত্রে হয়নি।

সুরতহাল রিপোর্টের সাথে ময়নাতদন্তের রিপোর্টের মিল নেই!

আবু সাঈদ নিহতের পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে করা সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টের মধ্যে কোন মিল নেই বলে জানিয়েছেন সাঈদ হত্যা মামলার আইনজীবী এডভোকেট রায়হানুজ্জামান।

তিনি বলেন, আবু সাঈদ নিহত হবার পর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার সময় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও একজন সাব-ইন্সপেক্টর সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাদের দেয়া সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী সাঈদের শরীরের কোথাও ঝাঝরা গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ছড়াগুলির জন্য শরীরে অসংখ্য গর্ত তৈরি হওয়ায় রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন হল সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির সময় সেখানে উপস্থিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের এসআই তার শরীরে কোন গুলির চিহ্ন কেন দেখতে পেল না,তারা এত বড় একটি ঘটনাকে কেন আড়াল করলেন? তাকে যেভাবে গুলি করা হয়েছে তা সারা বিশ্ববাসী দেখেছে কিন্তু সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করার সময় কেন দেখা হলো না। সত্যকে আড়াল করার অপরাধে পেনাল কোড ২০১ ধারা অনুযায়ী সুরতহাল রিপোর্টে প্রতিস্বাক্ষরকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের এসআইকে এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবীও জানান তিনি।

মামলার তদন্ত কত দূরে

আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় তার বড় ভাই রমজান আলীর বাদী হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত ভার পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরই মধ্যে হত্যার দিন ঘটনাস্থলে ছাত্রদের আন্দোলনে গুলি চালিয়ে বরখাস্ত হওয়া রংপুর মহানগর পুলিশের এএসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়কে গ্রেপ্তার করে চার দিনের রিমান্ডে নিয়েছে তদন্তকারী এই সংস্থা। সংস্থাটি এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিন রিপোর্ট সংগ্রহ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও জেলা পিবিআই পুলিশ সুপার জাকির হোসেন বলেন,ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিডিও ফুটেজের দেখে কতটুকু দূরত্ব থেকে গুলি করা হয়েছে  সেটি মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনা হবে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত বাকি আসামিদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রয়োজন সাপেক্ষে তাদের গ্রেফতার করা হবে।

পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি হিসেবে ডক্টর শওকত আলী যোগদানের পর শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িত শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিতকরণ ও শাস্তির ধরণ নির্ধারণের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ।

গত সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোঃ মিজানুর রহমানকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোঃ ফেরদৌস রহমান সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং কমিটির অন্য সদস্য হলেন একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আমির শরীফ।কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শওকত আলী বলেন,তদন্ত করে এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কি বলছে পুলিশ

মামলার তদন্তে পিবিআইকে পূর্ণ সহযোগিতা করা হচ্ছে জানিয়েছে মহানগর পুলিশ হেডকোয়ার্টার। এদিকে এ মামলায় শুধু পুলিশের একজন এএসআই ও একজন কনস্টেবলকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করালেও গুলির নির্দেশ দেয়া ঊর্ধ্বতন অফিসারদেরকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না বা তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্ন করা হয় সদ্য যোগ দেয়া রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ মজিদ আলীকে। জবাবে তিনি বলেন, ‍‍`যত উপরের র‍্যাঙ্কের পুলিশ অফিসার জড়িতে থাকুক না কেন কেউ পার পাবে না। এ মামলার তদন্ত করছেন পিবিআই পুলিশ সুপার।ঘটনার দিনের ভিডিও ফুটেজ ও তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।‍‍`

এর আগে ১৮ আগস্ট শনিবার সকালে রংপুর চিফ জুডিসিয়াল আদালতে হত্যা মামলা করেন আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী।

মামলায় আসামী করা হয়েছে,মহানগর পুলিশের এএসআই আমির আলী,কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়,বেরোবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, কোতোয়ালি জোনের সহকারি পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান,পরশুরাম জোনের সহকারি কমিশনার আল ইমরান হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার আবূ মারুফ হোসেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মশিউর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আসাদুজ্জামান মন্ডল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্প ইনচার্জ এসআই বিভূতিভূষণ, তাজহাট থানার ওসি রবিউল ইসলাম,বেরোবি শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার টগর,দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহফুজ মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি মোঃ আব্দুল বাতেন,পুলিশের সাবেক আইজিপি  চৌধুরী আব্দুল্লাহ মামুন সহ অজ্ঞাতনামা আরো ৩০/৩৫  জনকে।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!