ঢাকা শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি, ২০২৫
শুন্য হাতে রাজনীতিতে এসেছিলেন পলক

যেভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক বুনে যান পলক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০৬:৪১ পিএম

যেভাবে  হাজার কোটি টাকার মালিক বুনে যান পলক

ছবি: জুনায়েদ আহমেদ পলক।

. শেখ হাসিনাপুত্র জয়ের নাম ভাঙিয়ে করতেন সব কাজ
. উন্নয়নের ফুলঝুড়িতে স্বেচ্ছাচারিতা ধামাচাপা
. তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি 
. প্রকল্পের বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট
. স্ত্রী ও নিজের নামে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মন্ত্রী-এমপিরা যে যার মতো গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকে দেশ ত্যাগ করেছেন কেউবা আবার আটক হয়েছেন। তাদেরই একজন জুনাইদ আহমেদ পলক। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী। একটি হত্যা মামলায় জেলে রয়েছেন। এরইমধ্যে তার স্ত্রী ও পরিবারের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউ। 

মূলত সরকার পতনের পর থেকেই বের হয়ে আসছে স্বেচ্ছাচারী পলকের নানা দুর্নীতির কথা। নাটোরের সিংড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটিতে টানা চতুর্থবারের সংসদ সদস্য হন পলক। তিনবার হয়েছেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সব কাজই করতেন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ভাঙিয়ে। তার সঙ্গে সখ্যতা থাকায় সেভাবে জবাবদিহিতারও প্রয়োজন পারেনি পলকের। পলকের মিষ্টি কথা, সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে পয়সা খরচ করে দেখানো উন্নয়নের ফুলঝুড়িতে ধামাচাপাই থাকতো প্রভাবশালী পলকের স্বেচ্ছাচারিতা।

পলকের উত্থান জানতে যেতে হবে বেশ পেছনের দিকে। রাজনীতির শুরু থেকেই ধুরন্ধর পলক ২০০৬ সালের তৎকালীন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে শেখ হাসিনার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে মতিয়া চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং তার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সাথে কথা বলার সুযোগ পান। পরবর্তীতে পলক নৌকার মনোনয়ন লাভ করে এবং ১/১১’র কারণে নির্বাচন পিছিয়ে ২০০৮ সালে হলে তখনও তিনি মনোনয়ন পান।

পলকের পতন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন গনমাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের নামে একের এক প্রকল্প নিয়ে বাজেট থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ।

হলফনামা থেকে বেড়েছে যেভাবে সম্পদ

অথচ জুনাইদ আহমেদ পলক রাজনীতিতে এসেছিলেন শুন্য হাতে। হলফনামা ঘেটে দেখা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ধারদেনা করে খরচ জোগানো জুনাইদ আহমেদ পলকের ব্যাংকে ছিল ২০ হাজার এবং স্ত্রীর ছিল ১০ হাজার টাকা। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা এবারের হলফনামায় পলক উল্লেখ করেন, তার কাছে নগদ টাকা আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ১১২ টাকা। তার স্ত্রীর কাছে আছে ৪৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯১ টাকা।

অভিযোগ উঠেছে, পরিবারের সদস্যরাসহ তার নিজস্ব অনুগত কর্মীদের নামে-বেনামে পলক শত শত বিঘা জমি কিনেছেন ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তার নির্বাচনি এলাকায় ও এর বাইরে। একই সঙ্গে চাকরি বাণিজ্য, কালো টাকা, বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজি কমিশন, খাসজমি বরাদ্দ বাণিজ্যসহ অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন পলক। বর্তমানে নামে-বেনামে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে পলক ও তার স্ত্রীর আরিফা জেসমিন কণিকার নামে। পলকের স্ত্রী পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। কিন্তু গেল ১০ বছরে তিনিও কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন।

পলকে অসহায় ছিল আওয়ামী লীগের নেতারা 

শুধু তাই নয় , সিংড়ার আওয়ামী লীগে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য ত্যাগী আওয়ামী লীগের নেতাদের করেছেন উপেক্ষিত। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে শ্যালক লুৎফুল হাবিব রুবেলকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করার জন্যও উঠে পড়ে লাগেন তিনি। ঢাকার বাড়িতে মিটিং করে অন্য কাউকে নির্বাচনে না দাঁড়ানোর নির্দেশনাও দেন তিনি। পরবর্তীতে দেলোয়ার হোসেন পাশা নামে আওয়ামী লীগের একজন মনোনয়ন তুললে তাকে অপহরণ করে মারধর করা হয়। বিষয়টি বিভিন্ন গনমাধ্যমে উঠে আসলে দলীয় চাপে বাধ্য হয়ে পলক তার শ্যালককে মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।

জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত স্থানীয় সিংড়া উপজেলা বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে কব্জায় রেখেছিলেন পলক। ফলে তার অনুগত বিরোধী কিছু নেতাদের ব্যবহার করে পুরো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অকার্যকর করে রেখেছিলেন তিনি।

 বিএনপি নেতারা যা বলছেন 

স্থানীয় বিএনপি সূত্রে জানা যায়, প্রভাবশালী কিছু নেতাকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজের সুবিধামত বিএনপিকে ব্যবহার করে নিজের প্রভাব ধরে রেখেছিলো পলক। বিনিময়ে ২/৩ মিনিটের নামসর্বস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচিও করতে দিয়েছে বিএনপিকে, যা অনেকটা ছবি তুলেই শেষ। যা বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে ওপেন সিক্রেট ছিল।

স্বেচ্ছাচারিতা পলক যেমন ছিল 

পলকের স্বেচ্ছাচারিতার কথা সিংড়াব্যাপী প্রচলিত আছে। নিজের আনুগত্য শিকার না করলেই চলতো দমন নিপিড়ন। এ থেকে বাদ যায়নি অধ্যক্ষ, শিক্ষকসহ সুশীল সমাজের কেউই। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সিংড়ায় সর্বপ্রথম পলকের রোষানলে পড়ে চাকরি হারান বিএনপি সমর্থক অধ্যক্ষ শেখ মো. রকিবুল ইসলাম। সে সময় সিংড়ার তৎকালীন এমপি জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশে ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতায় সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার অধ্যক্ষ রকিবুলকে বেআইনি ভাবে বরখাস্ত করেন। 
দীর্ঘ চার বছর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সরকারি আদেশকে বে-আইনী প্রমাণ করে আদালতের আদেশে অধ্যক্ষ রকিবুল পুনর্বহাল হন।

এ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ শেখ মো. রকিবুল ইসলাম বলেন, পলক ও আওয়ামী লীগের সমর্থক না হওয়ায় বিগত সরকারের আমলে অন্যায়ভাবে দমন নিপিড়ন চালানো হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো উন্নয়ন বঞ্চিত করেছে। প্রতিষ্ঠানের বহুতল ভবন ও ডিজিটাল ল্যাব বরাদ্দের জন্য নাম আসলেও বার বার সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক অন্যায়ভাবে তা কেটে দিয়েছেন।

পলক প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব রহিম নেওয়াজ বলেন, অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের উত্থান হয়েছিল। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার মালিক হতে পারে তাহলে বুঝতেই পারেন তাদের মন্ত্রী এমপিদের কি অবস্থা হতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের সাথে সখ্যতা থাকার কারণে এত বেশি দুর্নীতি করে অর্থলোপাট করেছে যার হিসাব নেই। জুনায়েদ আহমেদ পলকের এসব দুর্নীতির চিত্র ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে। আমরা চাই এগুলোর সঠিক তদন্ত হোক এবং পাচারকৃত অর্থদেশে ফিরিয়ে আনা হোক।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর নাটোর জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বুলবুল আহমেদ বলেন, সরকার পতনের পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে মাধ্যমে জানতে পারছি আইসিটি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন জুনায়েদ আহমেদ পলক। নামে বেনামে প্রকল্প দিয়ে অর্থ লোপাট করে বিদেশে পাচার করেছে। তাদের সাধারণ মানুষের কাছে চেহারা এক রকম, আর প্রকৃত চেহারা অন্য রকম। রাজনৈতিকে ব্যবহার করে এরকম দানব যাতে তৈরি না হয় সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেইসাথে যেসকল রাজনৈতিক দল এমন দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিবে সেসব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আমি মনে করি দুর্নীতিবাজ নেতৃত্ব সরাতে রাজনৈতিক দলগুলোর শুদ্ধি অভিযান করা দরকার।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!