বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দিয়ে টয়লেট (পায়খানা) পরিস্কার করে নেওয়া, শিক্ষকের ব্যক্তিগত কাজ করে নেওয়াসহ নানা ধরণের কাজ করানো হয় বলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ইচ্ছেমতো ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দিয়ে নোংরা টয়লেট পরিস্কার করে নেওয়া হয়। কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে মারধর করারও অভিযোগ আছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তাই ভয়ে আসতে চায়না বিদ্যালয়ে। এমন বিস্তর অভিযোগ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজা খানমের বিরুদ্ধে। অবশ্য অকপটে স্বীকারও করলেন সেখানে কর্মরত একাধিক শিক্ষক।
ঘটনাটি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত শলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩শত জন।
অভিযোগ প্রাথমিক এই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের দিয়ে টয়লেট (পায়খানা) পরিস্কার করে নেওয়া হয়। ওই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজা খানম নিজের ইচ্ছেমতো ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দিয়ে নোংরা টয়লেট পরিস্কার করে নেয়। কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে মারধর করারও অভিযোগ আছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তাই ভয়ে আসতে চায়না বিদ্যালয়ে।
বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা-মাকে বললে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এতে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেয়, সন্তানরাও যেতে চাচ্ছেনা স্কুলে। ফলে ঘটনার প্রতিকার চেয়ে শিক্ষার্থীদের কয়েকজন অভিভাবক মিলে গত ৩১ অক্টোবর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, সন্তানেরা বিদ্যালয়ে গেলে ক্লাস চলাকালীন প্রায় তাদের দিয়ে বিদ্যালয়ের অব্যবহারযোগ্য পায়খানা পরিস্কার করে নেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজা খানম ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দিয়ে করাতে বাধ্য করে। গত ২৩ অক্টোবর সকালে ক্লাস চলাকালীন সময়ে প্রধান শিক্ষক ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ডেকে নেয়। এরপর তাদের দিয়ে জোর করে পায়খানা পরিস্কার করানো হয়। ফলে তাদের কাছে বিদ্যালয়ের প্রতি ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি হয়। একারণে তারা বিদ্যালয়ে যেতে চাচ্ছে না।
এছাড়া ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরেন কর্মরত একাধিক শিক্ষক ও অভিভাবকসদস্য। তারা জানান, ২০২৩ সালের পঞ্চম শ্রেণীর উত্তীর্ণ ৪৮ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলনা ও বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সরকারি বরাদ্দের নামমাত্র কাজ করা হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে মানসিক প্রতিবন্ধীর মত আচরণ করা। গ্রেডেশন তালিকায় জুনিয়র শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন আওয়ামী লীগের লোকজনকে ম্যানেজ করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ। কথায় কথায় অন্যান্য শিক্ষকদের হুমকি প্রদান। এবং অভিভাবকদের সাথে অসদআচরণ করা।
অভিযোগকারী কয়েকজন অভিভাবক বলেন, এই কাজগুলো বিদ্যালয়ে একজন দপ্তরী থাকা সত্ত্বেও আমাদের সন্তানেরা করবে কেন? আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পড়াশোনা করার জন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে পায়খানা পরিস্কার করবে এটা মেনে নেওয়ার মতো না।
সোমবার ৪ নভেম্বর বিকেলের দিকে জানতে চাইলে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজা খানম মুঠোফোনে বলেন, গত বুধবার আমি ও আমার পিওনসহ শুধুমাত্র ৫ম শ্রেণির কয়েকজনকে নিয়ে গিয়ে পানি দিয়ে পরিস্কার করা হয়েছে। তবে নোংরা টয়লেট পরিস্কার করানো হয়নি। আর সেদিন স্কুল পরিদর্শণে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষরা এসেছিলেন। তাই তাদের দিয়ে একদিনই পরিস্কার করানো হয়। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও চলছে বলে জানান তিনি। আর অন্যান্য অভিযোগগুলো সম্পন্ন মিথ্যে ও বানোয়াট দাবি করে তিনি বলেন, খেলনা কেনার জন্য যে বরাদ্দ এসেছিল, সেগুলো অফিসের মাধ্যমে কেনা হয়েছে। এরকম কয়েকটি স্কুলে এই বরাদ্দ এসেছিল। আমি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা।
জানতে চাইলে আত্রাই উপজেলা শিক্ষা অফিসার মাযহারুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ইউএনও বরাবর দেওয়া আছে। কিন্তু আমার কাছে আসেনি। আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শিশুদের সম্পৃক্ত করানো যাবে এটা বলা আছে। যেহেতু একজন দপ্তরী আছে, কাজেই তাদেরকে সহযোগী হিসেবে রাখা যাবে। শুধুমাত্র শিশুদের দিয়ে করানো যাবেনা। তারপরও আমি বিষয়টি দেখবো, নিজের উদ্যোগে জেনে নিচ্ছি।
জানতে চাইলে বিষয়টি আমার জানা নেই বলে জানালেন আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামাল হোসেন। তবে বিষয়টি এখনই খোঁজ নিচ্ছি বলে জানালেন তিনি।
শিক্ষার্থীরা জানান, আমরা যদি ম্যাডামের কথা না শুনি তাহলে পরবর্তীতে মারবে। তাই বাধ্য হয়ে পায়খানা পরিস্কার করতে হয়েছে। একদিন ছেলেদের দিয়ে করে নেয়, আর একদিন মেয়েদের দিয়ে। এসব করতে ভালো লাগেনা। তাই আমরা আমাদের বাবা-মাকে বলেছি। বাবা-মা যেতে দিতে চাচ্ছেনা। সেই জন্য দিন দিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সরেজমিনে গ্রামে ও স্কুলে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেল। সেখানে উপস্থিত একাধিক শিক্ষকও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। তবে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কারণে তারা ভিডিও বক্তব্য দিতে রাজিনা।
এদিকে একই প্রাচীরের মধ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়। আর একই মাঠে খেলা করছিল উভয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। টিফিন টাইমে তাদের দুরুন্তপনা দেখার মতো। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভয়ে স্কুলে আসতে চাচ্ছেনা। এক সময় এই বিদ্যালয়ে সুনাম ছিল উপজেলা জুড়ে। অনেক শিক্ষার্থী পেত স্কলারশীপ। আবার ফিরে আসুক সুনাম এমনটাই চাওয়া শিক্ষক ও অভিভাবকদের।
আপনার মতামত লিখুন :