ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
বোয়ালখালী পৌরসভা

নানা অনিয়মে গিলে খেয়েছে ‍‍`সিন্ডিকেট‍‍`

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪, ০১:২০ পিএম

নানা অনিয়মে গিলে খেয়েছে ‍‍`সিন্ডিকেট‍‍`

ছবি-বর্তমান বাংলাদেশ।

২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বোয়ালখালী পৌরসভা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র হন দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম। মেয়র নির্বাচিত হয়ে তিনি ঠিকাদার সিন্ডিকেট সৃষ্টি করেন।

 

কমিশনের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতেন। এর বাইরে কোনো ঠিকাদার কাজ পেতেন না।

 

স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ, নিয়োগ-বাণিজ্য, সরকারি ভবন নির্মাণে কারসাজি- এমন কোনও কাজ নেই যা জহুরুল ইসলাম করেননি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে গেলে পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমাকে।

 

জানা গেছে, বর্তমানে পৌরসভায় প্রায় ১০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান। যা জহুর সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর আগেও আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের যোগসাজশে সব ঠিকাদারি কাজ নিজেরাই ভাগিয়ে নিতেন।

 

এ সিন্ডিকেটের তালিকায় আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল মোনাফ, চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ১-এর এলাকা পরিচালক ও যুবলীগ নেতা সাইফুদ্দিন মোহাম্মদ বেলাল এবং যুবলীগ কর্মী বাদল ও ৫ নং পৌর ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা সাইফু, ৭নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মাহমুদুল হক।

 

নামসর্বস্ব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে গোপনে দলীয় ও আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক পৌর মেয়র জহুরুল ইসলাম। ২০২২ ও ২০২৩ সালে দুই ধাপে ১০ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। খেয়ালখুশির এ নিয়োগে সহকারী কর আদায়কারী পদে মো. নেজাম উদ্দীন, সার্ভেয়ার পদে আবদুর রহমান, বিদ্যুৎ হেলপার রবিউল হোসেন মাস্টার্স পাস হলে ৮ম শ্রেণির শিক্ষা সনদ, জন্ম সনদ ও এনআইডি জালিয়াতি করে বয়স কমিয়ে নিয়োগ নেন। ৫০ বছর বয়ষ্ক অফিস সহায়ক বাবর হোসেনকে আত্তীকরণ দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বয়স কমিয়ে নিয়োগ পান, আমিরুল ইসলাম তিহা (সাবেক মেয়র জহুরুলের ভাইপো) সে নিয়োগ আবেদনের সাথে চাহিত পে অর্ডার শেষদিনেও জমা দেয়নি। পরদিন পে অর্ডার ব্যাক ডেইটে জমা দেন, ওয়াহিদুল আলম, কার্য সহকারী রোকন উদ্দিন ও সহকারী ঠিকাদার হিসেবে মো. নোমান নিয়োগ পান। তারা সবাই জহুরুল ইসলামের কাছের লোক, কেউ তার এলাকার বাসিন্দা কেউবা আত্মীয় কিংবা স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী।

ভবন নির্মাণে অনুমতি পত্রের অর্থ নিয়ে কারসাজি  

জহুরুল ইসলাম পৌর মেয়র থাকাকালীন ভুয়া বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি পত্র ও নকশা প্রদান করার অভিযোগ উঠেছে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সব অনিয়মে দুই প্রকৌশলূ জড়িত। এক উপ সহকারী প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি ধর ও সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান ও নকশাকার তসলিনা আরজু শিল্পী। এসব অনুমতি পত্রের বিপরীতে পৌর ফি ফাঁকি দিতে পৌর বালামে সব অনুমতি পত্রের রেকর্ড রাখা হতো না। অথচ আবেদনকারীর কাছ থেকে পৌর ফি ও অনুমতি প্রদানের জন্য নেওয়া হতো লাখ লাখ টাকা। ভুয়া অনুমতি পত্র প্রদানের একাধিক তথ্য এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

 

এর মধ্যে চলতি বছরের গত ২৩ জুলাই পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি নির্মাণ অনুমতি পত্রে দেখা যায়, পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল জলিল নামের এক ব্যক্তিকে ৪ তলাবিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া পৌর প্রকৌশলীসহ একাধিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে প্রদানকৃত ভবনের নকশায়। তবে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই পৌর বালামে।

 

ভবন নির্মাণের নকশা তৈরি, সার্ভে প্রতিবেদন, সয়েল টেস্টসহ যাবতীয় কাগজপত্র পর্যালোচনা করেই পৌর অ্যাকাউন্টে ফি জমাদানপূর্বক অনুমতি পেয়ে থাকেন পৌর বাসিন্দারা। এক্ষেত্রে বাসিন্দাদের সব ফি ও উপরি টাকা প্রদান করতে হয়। এসব অর্থ আত্মসাৎ করতে জালিয়াতি করে অনুমতি পত্র প্রদান করার অভিযোগ আছে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

 

ভবন নির্মাণে ভুয়া অনুমতি পত্র দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী মৃনাল কান্তি ধর। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রি ছাড়া কাউকে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয় না। গ্রাহক কাগজপত্র জমা দিলে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে আমাদের সার্ভেয়ার সরেজমিন তদন্ত করেন। এরপর ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেন। এক্ষেত্রে জালিয়াতি করার কোনো সুযোগ নেই।

 

বোয়ালখালী পৌরসভার গোমদণ্ডী ফুলতল মোড়ে সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গায় পৌরসভা কাঁচাবাজার নির্মাণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলামের নির্দেশে টেন্ডার ছাড়া কোটেশনের মাধ্যমে নির্মাণ ব্যয় দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার বানিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। সাবেক মেয়র কাউন্সিলর ও যুবলীগ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা ভাগ বাটোয়ারা ভাগ হিসেবে ফুলতল কাঁচা বাজারের দোকান ভাগ করে নেয়। বাদ যায়নি প্রধান সহকারী সাইফুদ্দিন খালেদ।

ব্যক্তিগত সহকারীর দাপট

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন খালেদ বোয়ালখালী পৌর মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী নিযুক্ত হন। এতেই কপাল খুলে যায় তার।  

 

স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পৌরসভা সম্পর্কিত আইনানুযায়ী, প্রধান সহকারী পদটি প্রথম ও তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভায় নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু বোয়ালখালী পৌরসভা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত পৌরসভা। এ ধরনের পৌরসভার সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রধান সহকারী নামে কোনো পদ নেই। তবুও এই পদ সৃষ্টি করে জহুরুল ইসলাম তার ব্যক্তিগত সহকারী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুদ্দিন ওরফে খালেদকে নিয়োগ দেন। তাকে নিয়োগ দিতে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় প্রধান সহকারী পদ সৃষ্টি করেন।  

 

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বোয়ালখালী পৌরসভার মেয়র জহুরুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন। কিন্তু এখনো অবৈধভাবে চাকরি করে যাচ্ছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুদ্দিন। এ পদ ব্যবহার করে তিনি দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আয় করার অভিযোগ রয়েছে। আর তাকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বর্তমান পৌর প্রশাসক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা। তিনি পৌরসভায় সাইফুদ্দিন নামে কেউ চাকরি করে না বলে জানালেও, পরে এ প্রতিবেদক সাইফুদ্দিনের চাকরির নথিপত্র পাঠালে বিষয়টি স্বীকার করেন।

 

তিনি বলেন, পৌরসভায় প্রধান সহকারী নামে কোনো পদ নেই। তবে সাবেক পৌর মেয়র জহুরুল ইসলামের সময়ে সাইফুদ্দিন খালেদ নামে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাকে নিয়োগকৃত পদটির বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন ছিল।

 

সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বোয়ালখালী পৌরসভার কর্মকর্তা কর্মচারীর তালিকা চাওয়া হয়। এতে পৌর প্রশাসক চাহিত তালিকা প্রেরণ করেছেন। তবে ওই তালিকায় প্রধান সহকারীর পদটি উল্লেখ করেননি। অথচ ওই পদে আসীন সাইফুদ্দিন মাসিক বেতন ভাতা পাচ্ছেন।

 

বোয়ালখালী পৌরসভার সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, আমি যখন পৌরসভায় সচিব হিসেবে যোগদান করি তখন সাইফুদ্দিনের নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। আমি এসে শুধু নিয়োগ পত্রে স্বাক্ষর করেছি।

 

অভিযুক্ত মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, আমি মেয়রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ছিলাম। পরে সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করি। সেখানে আমার নিয়োগ হয়। এ রকম পদ আগে ছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আসছে এ পদটি।  

 

বোয়ালখালী পৌরসভার অস্থায়ী চৌকিদার কধুরখীলের বাসিন্দা আবুল কাশেম ২০১৬ সালে মৃত্যুর বরণ করেন পুকুরের পানিতে ডুবে। বিষয়টি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারও হয়। ২০২২ সালে ওই নিহত চৌকিদার স্থলে জীবিত দেখিয়ে পশ্চিম গোমদণ্ডী ৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আওয়ামী নেতা আবুল কাশেমকে বয়স কমিয়ে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দেন। তার বয়স অথচ ৫২ বছর। তার জন্ম সনদ,  এনআইডি ও শিক্ষা সনদ জাল জালিয়াতি মাধ্যমে মৃত কাশেমকে জীবিত দেখিয়ে আত্তীকরণের মাধ্যমে জীবিত কাশেমকে নিয়োগ দেন।

 

এমন কি পৌরসভার দুই প্রকৌশলী ১) উপ সহকারী প্রকৌশলী মৃনাল কান্তি ধর, ২) সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান, বেইজ ম্যাপে আই সো প্ল্যান সড়ক নাম প্রকল্পে দুই দানব প্রকৌশলী ঘুষ দুর্নীতির টাকা কারণে পৌর অর্থ ক্ষতিগ্রস্থ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি ও টেন্ডার নির্মাণ কাজ কোটেশনের নামে লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ অনিয়ম দূর্নীতি, লুটপাঠ, ভূয়া নিয়োগ বানিজ্যে দুই দানবেই মূল হোতা, পৌরসভার অনিয়ম দুর্নীতি লুটপাঠ, ভূয়া নিয়োগ বাণিজ্যে এবং পৌর সভার ফুলতল কাঁচা বাজার দূর্নীতির নিয়ে পৌরসভা এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্ঠা, স্থানীয় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব, জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় সচিব, টি আই বি, দূর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় অনিয়ম দূর্নীতি বিরুদ্ধে প্রকাশিত হইলে কোন প্রতিকার হয়নি, মনে হয় সব জায়গায় প্রশাসনের আওয়ামীগের দোসর, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ অফিসাররা গাপটি মেরে আছে।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!