বিশ্বের শীর্ষ ফুটবলারদের শরীরে চোট খুঁজতে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতো, তাই এখন কাজে লাগছে সাধারণ খেলোয়াড়দের হাঁটু বা পিঠের ব্যথা সারাতে৷ স্পোর্টস মেডিসিনের পরীক্ষাগারে এক বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স অ্যানালিসিস পরীক্ষা চলছে৷ পরীক্ষকের ইশারায় হাওয়ায় লাফ দিয়ে এক পায়ে এসে নামতে হবে একটি নির্দিষ্ট বাক্সের ভেতরের জায়গাতেই৷
পরীক্ষকের ভূমিকায় ড. হাউকে ডেউইটৎজ। আরো একবার দরকার! ১৬ বছর বয়সি এই খেলোয়াড় লাফাতে থাকে, শরীরে ছোট বিড বা পুঁতি, অন্যান্য মার্কার ও ইলেকট্রোড নিয়ে, যা তার পেশির পরীক্ষা করে৷ কয়েক মাস ধরে ডান হাঁটুর ব্যথা ভোগাচ্ছে এই খেলোয়াড়কে৷ তাই সে আজ এই ল্যাবে৷ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হবার পর, খেলোয়াড়দের হাড় বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট প্রস্তুত৷ হাঁটুর মধ্যে থাকা পাটেলার টেন্ডন কেন আঘাতপ্রাপ্ত, এই পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন ড. ডেউইটৎজ৷ কেন অজান্তেই হাঁটু একদিকে হেলে যায়? পেশিগুলি কি ঠিকঠাক ভাবে শরীরের গতি কমাতে পারছে? হাড়ের সন্ধিস্থলে বা জয়েন্টে এর কেমন প্রভাব পড়ছে? বায়োমেকানিক্যাল বিশ্লেষণ এর উত্তর দিতে পারবে৷
দুঘন্টারও বেশি সময় ধরে খেলোয়াড়কে দৌড়াতে হয়েছে দিক বদল করে করে৷ মাঝে ওঠবোস করতেও হয় তাকে৷ সাথে, শরীর কতটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে বা পেশির জোর কতটুকু তাও মাপা হয় পরীক্ষায়৷ খেলোয়াড়দের প্রতিদিনের যে সমস্যা কোলনে সবার সাথে অনুশীলন করতে আসেন নামকরা অ্যাথলেটরাও৷ পেশাদার ক্লাব ও তার খেলোয়াড়দের কাছে স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক সমস্যার সমাধান বার করতে কোনো পথই ছাড়েন না তারা৷
ডেউইটৎজ বলেন, আগে থেকে প্রিভেন্টিভ কেয়ার নিতে খুব বেশি খেলোয়াড়রা আসেন না আমাদের কাছে৷ তাতে সমস্যা আগেই ঠেকানো সম্ভব, বলে মনে করেন তিনি৷ বেশিরভাগই আসেন কোন অপারেশন হবার বা চোট লাগার পর, যেমন যে সব চোট ঘন ঘন লাগে, ফাইবার ছিঁড়ে যাওয়া বা উরুর পেশিতে টান পড়া৷ নতুন ধরনের ব্যথা বা যন্ত্রণা ছাড়া খেলোয়াড়দের সমস্যাও আর পাঁচটা লোকের মতোই, যেমন টেন্ডনের ব্যথা, পেশি বা হাড় সন্ধি ধকল সইতে না পারা৷ এমনটাই বলছে ড. উইটৎজের অভিজ্ঞতা৷
তিনি বলেন, মানুষ সব সময় ভাবে যে পেশাদার খেলোয়াড়রা এতটা প্রশিক্ষিত বলেই তাদের পরীক্ষায় কোনো দুর্বলতা ধরা পড়ে না৷ কিন্তু বাস্কেটবল বা ফুটবলের মতো খেলায় দুর্বলতা থাকে গভীরে৷ উদাহরণস্বরূপ, গুরুত্বপূর্ণ পেশি দুর্বল হওয়া, হাড় সন্ধি চাপ নিতে না পারা, বলেন ডেউইটৎজ৷ আমাকে সেটা সব সময় অবাক করে, বলেন তিনি৷
কিন্তু মোশন অ্যানালিসিস বা গতি অধ্যয়ন থেকে সমস্যার কোনো সুরাহা হয় না৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে কাজে লাগবে লাইপৎজিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেকানিকস ল্যাবের প্রধান প্রফেসর মারেন ভিট বলেন, এটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য দেবে৷ এআই পরীক্ষার ফলাফল ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট ও রোগীদের জানাবে ব্যথা কোথা থেকে আসছে ও কীভাবে তার সুরাহা হবে৷
ভিট বলেন, আমরা বর্তমানে দেখছি কীভাবে এই প্রযুক্তি, যা এত দিন শুধু শীর্ষ পদে থাকা খেলোয়াড়দের জন্য বরাদ্দ ছিল, তা আজ বহু লোকের হাতের নাগালে৷ এক সময় ব্যক্তিগত পরীক্ষা করতে কয়েক দিন লাগত৷ এখন তাই সম্ভব কয়েক ঘন্টায়৷ ভিট আরো বলেন, ভবিষ্যতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শরীরে মার্কিং করা বা দাগ দেওয়াকেও অপ্রয়োজনীয় সাব্যস্ত করবে৷ সময় বাঁচাবার সাথে সাথে এটা তাদেরও সাহায্য করবে, যারা হাঁটু, কোমর বা পিঠের সমস্যায় পরীক্ষা করালেও সুইমস্যুট পরতে চান না৷
আগামী কয়েক বছরে, হাউকে ডেউইটৎজ আশা করেন যে ল্যাবের পাশাপাশি, স্বাভাবিক প্রশিক্ষণের পরিবেশে বা খেলার মাঠেই যাতে খেলোয়াড়রা নিজেদের পরীক্ষা করতে পারেন৷ তিনি বোঝান, তাতে আরো ব্যক্তিভিত্তিক পরীক্ষা সম্ভব হবে ও ব্যথার কেন্দ্রভিত্তিকও৷ টার্গেট ভিত্তিক প্রশিক্ষণ তরুণ খেলোয়াড়ের ওপর দুঘন্টারও বেশি সময় ধরে পরীক্ষা চালিয়ে আশার আলো দেখছেন ডেউইটৎজ৷
সাড়ে ছয় ফুটেরও বেশি উচ্চতার এই তরুণ বাঁ পায়ে ভালোভাবে লাফ দিয়ে নামতে পারেন৷ কিন্তু ততোটা ভালোভাবে এটা ডানপায়ে হচ্ছে না৷ সেক্ষেত্রে, পা খানিকটা বেঁকে যায় ও পাটেলার টেন্ডনে চোট লাগে৷ টার্গেটেড প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন তিনি৷ যার মধ্যে আছে উরু ও নিতম্বের পেশির জোর বাড়ানোর ব্যায়াম৷ সাথে আছে দৌড় ও লাফ দিয়ে নামার নানা কৌশলও৷ দৈনন্দিনের ব্যবহারে কতটা উপকারী হতে পারে এমন প্রশিক্ষণ? প্রফেসর ভিট বলেন, উচ্চ মাত্রার পারফর্মেন্সের খেলায় আমরা ধরে নিচ্ছি যে এটা কার্যকর৷ যদিও এর যুক্তি হিসাবে শুধু মুভমেন্ট বিশ্লেষণকে একা দেখলে হবে না৷ কারণ একজন খেলোয়াড়ের পারফর্মেন্সের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের নানা রকমের ভূমিকা থাকে৷ এক্ষেত্রে ডেউইটৎজ বলেন আরেক জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়ের কথা, যার হ্যামস্ট্রিং কয়েক বছর ধরেই ভোগাচ্ছিল ও কোনো পরিচিত মেডিকাল উপায়েই তার সমাধান আসছিল না৷ এই অ্যানালিসিস জানায় যে ব্যথার কারণ সহজ৷ একটি পেশির দুর্বলতার চাপ এসে পড়ছে আরেকটি পেশির ওপর৷ টার্গেটেড প্রশিক্ষণের সাহায্যে সমস্যা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷
তার বক্তব্য, যে কোনো ফিজিওথেরাপিস্ট বা স্পোর্টস বিজ্ঞানী এটা করতে পারেন৷ তার জন্য পেছনে বড় ফুটবল ক্লাব বা কয়েক মিলিয়নের সম্পদ থাকার প্রয়োজন নেই।
আপনার মতামত লিখুন :